–নার্সারিতে নতুন একটা মেয়ে ভর্তি হয়েছে। দেখতে ভীষণ মিষ্টি। প্রথম যেদিন আমি ক্লাসে গিয়েছিলাম সেদিনই খেয়াল করি মেয়েটার দিকে। থুতনির মধ্যে একটা ছোট তিল আছে। চুলগুলো বেশ সিল্ক। দুই ঝুটি করে স্কুলে আসছে। খুব কিউট লাগলো মেয়েটাকে দেখতে। ক্লাস শেষ করে মেয়েটার কাছে গিয়ে আলতো করে গাল টিপে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
–কি নাম তোমার ?
–তিতিক্ষা । (মিষ্টি করে হেসে দিয়ে মেয়েটা বললো। সামনের মাড়ির দুটো দাঁত নেই। বয়স ছয় কি সাত হবে।)
–তিতিক্ষা ! (নামটা শুনে থমকে গেলাম। খুব পরিচিত কিছু সময় মনে পড়ে গেলো। এই নামটার সাথে আমার জীবনের পাঁচটি বছর জড়িয়ে আছে। মনে হলো, এইতো সেদিন, তানভীর আমার চুলে হাত বুলাচ্ছে আর বলছে,
তৃণা, আমাদের মেয়ে হলে ‘তিতিক্ষা’ নাম রাখবো। যার অর্থ ক্ষমা করা বা মেনে নেওয়া। যেন আমাদের কোনো কারণে মনোমালিন্য হলে তিতিক্ষা’র নাম বলতেই সব মিটমাট হয়ে যাবে। দারুণ হবে বলো। ভাবনার সমাপ্তি ঘটিয়ে মেয়েটাকে প্রচুর কৌতুহল নিয়ে প্রশ্ন করলাম,)
তোমার বাবার নাম কি ?
–তানভীর । (মেয়েটা ব্যাগ গুঁছিয়ে নিচ্ছে আর আমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে।)
–তানভীর !
(আবার সেই পুরোনো সময় এসে হাতছানি দিলো ঝাপসা দৃষ্টিতে। চোখ মুছে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছি। মানুষ ভাগ্য করে সন্তানের পিতা-মাতা হয়। যে ভাগ্য আমার হয় নি। পাঁচবছরের সংসার ছিলো আমাদের। সবকিছুই ঠিকঠাক ছিলো। বলা যায় সুখের সংসার। শ্বশুর শাশুড়ি, ননদ, দেবর, স্বামী সবাইকে নিয়ে আমার সংসার বেশ চলে যাচ্ছিলো। কিন্তু অভাব ছিলো একটি সন্তানের। একটি সন্তানের জন্য শেষ পর্যন্ত আমার সংসারটা আর টিকলো না। ভেঙ্গে গেলো সুখের সংসার।)
–মিস্ আমি যাই ? ছুটি হয়ে গেছে।
–ওহ্ হ্যাঁ। দাঁড়াও তিতিক্ষা..
–জ্বী মিস্ ।
–তুমি কার সাথে যাবে ? কেউ নিয়ে যাওয়ার জন্য এসেছে ?
–আমার বাবা এসেছে মিস্। (কথাটি বলে তিতিক্ষা দৌঁড়ে ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে স্কুল গেইটের কাছে চলে গেলো।)
–আমি আড়াল থেকে নিখুঁত ভাবে তাকিয়ে আছি গেইটের দিকে। মেয়েটার বাবা কে সেটা জানার জন্য ।
হঠাৎ তিতিক্ষাকে দেখলাম লোকটার হাত ধরে চলে যাচ্ছে। দুর্ভাগ্যবশত লোকটার চেহারা দেখতে পারলাম না।
পুরোটা দিন আমার ভীষণ কঠিনভাবে কেটেছিলো। বারবার মনে হয়েছিলো, তিতিক্ষার বাবা-ই কি আমার স্বামী তানভীর ? নাকি অন্য কেউ ? তানভীর নামে তো একজন নেই দুনিয়াতে।
আচ্ছা,
তানভীর কি এতোদিনে বিয়ে করেনি ? আমিতো তানভীরকে ডিভোর্স দেই নি। তাহলে ও কীভাবে বিয়ে করবে ? নানান প্রশ্ন মাথায় ঘোরপ্যাঁচ করছে।
পরেরদিন রেডি হয়ে স্কুলে গেলাম। আজ আমাকে নিশ্চিত হতেই হবে তানভীর বিয়ে করেছে কিনা সেই ব্যাপারে।
অতীতগুলো সবসময় জীবন্ত। এদের তরতাজা করতে সেই সময়টা ফিরে পাওয়ার প্রয়োজন হয়না। কেবল সেই সময়ের মানুষগুলো বা সেই অতীত প্রাসঙ্গিক কোনো কিছু ঘটলে হলো। তখন মনে হয় কেউ খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে অতীতকে সামনে নিয়ে আসে।
কিন্তু তারপরেও সময় বা পরিস্থিতিকে সামাল দিতে ভুলে থাকার অভিনয় করতে হয় আমাদের। আমরা মানুষরা আসলেই এক একজন ভীষণ বড় অভিনেতা।
আজও স্কুল শেষে তিতিক্ষার বাবাকে দেখতে পেলাম না। আসলে এত দূর থেকে মানুষের ভীড়ে স্পষ্ট দেখাই যাচ্ছিলো না।
সাইড ব্যাগটা গুঁছিয়ে মন খারাপ করে স্কুল থেকে বেরিয়ে রিকশার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।
ঠিক তখন ই অতীত হঠাৎ করে আমার সামনে দাঁড়িয়ে রইলো।
হ্যাঁ আমার সামনে তানভীর দাঁড়িয়ে আছে।
–কেমন আছো তৃণা ? (জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তানভীর)
–ভালো।বিয়ে কবে করেছো ?
–মিস্ , বাবা তো বিয়ে করেনি। জানো মিস্ দূর থেকে তোমাকে দেখেই আমি বাবাকে বললাম, ঐ যে আমাদের তৃণা ম্যাডাম। (চকলেট খেতে খেতে তিতিক্ষা বললো।)
–বিয়ে করোনি তানভির ? তাহলে তিতিক্ষা ?
–ও ঝুমুরের মেয়ে। (ঝুমুর আমার ননদ।)
–কিন্তু ওর নাম তিতিক্ষা কেন রাখলে ?
–ঝুমুরের মেয়েটা হওয়ার সময় ও মারা যায়। ও মারা যাওয়ার আগে তিতিক্ষাকে আমার হাতে তুলে দিয়ে যায়। সেই থেকে ওকে তিতিক্ষা নামেই ডাকি।
তৃণা তুমি আমাকে এভাবে একা রেখে কেন হারিয়ে গেলে? তুমি জানো তোমাকে আমি কত খুঁজেছি ! কোথাও পাইনা।
–তানভীর, আমার খুব ভয় হতো। বারবার মনে হতো হয়তো তোমাকে আমি ঠকাচ্ছি। আমার জন্য তুমি বাবা ডাক শুনতে পারছোনা, বিয়েও করতে পারছোনা।
–এমনটা কখনই না তৃণা। তুমি মিথ্যে ভয় পেয়েছিলে। এইতো তোমার তিতিক্ষা। আর দূরে সরে থেকোনা। ফিরে চলো তৃণা।
–মিস্ তুমি আমাদের সাথে যাবে? (কৌতুহল দৃষ্টিতে তিতিক্ষা বললো।)
–যাবো তো।যদি তুমি আমাকে মিস্ না বলে মা বলো তাহলে। বলবে ?
–আচ্ছা । (মৃদু হেসে)
–আমরা দু’জন তিতিক্ষার দুহাত ধরে হাঁটছি।
ভাগ্য নামক জিনিসটা আছে বলেই মানুষ পাওয়ার আশা করে।আজ ভাগ্য ভালো বলেই আমি আমার তানভীর আর তিতিক্ষাকে ফেরত পেলাম।
লিখেছেনঃ উম্মে_হাবিবা_তানহা