একটা কথা আমি প্রায়ই সবাইকে বলে থাকিঃ জীবনটা খুব সহজ। Funny, ঝঞ্ঝাটমুক্ত আর চরম উপভোগ্য! এটাকে জটিল ভাবে চিন্তা না করলেই হয়। মানুষ অনর্থক জীবনকে হতাশায় পরিপূর্ণ এক বোঝায় পরিণত করেছে। দারুণ এই উপলব্ধিটি আমার মাথায় আগে আসে নি। আমি যখন ব্যাংকক ছিলাম আমার কাছেও জীবনটা খুব নিষ্ঠুর আর জটিল ছিল।
আমার জন্ম থাইল্যান্ডের উত্তরাঞ্চলে। নিতান্ত দরীদ্র ঘরে জন্ম হয় আমার। যখন ছোট ছিলাম জীবনটা আমাদের কাছে ছিল আনন্দে পরিপূর্ণ। দারুণ ভাবে আমরা একে উপভোগ করতাম। পুরো গ্রামটাতে যেন স্বর্গ নেমে এসেছিল। কিন্তু যখন টেলিভিশন আসলো, মানুষ প্রযুক্তির মাধ্যমে সারা বিশ্ব সম্পর্কে জানতে আরম্ভ করলো তখন তারা আমার চোখে আঙ্গুল দিয়ে বলা শুরু করলো তুমি গরীব! তোমাকে জীবনে সফল হতে হবে! গরীব বলে এই প্রথমই সম্ভবত খারাপ লাগলো। চিন্তা করলাম, আমাকে সফল হবার জন্য অনেক পরিশ্রম করতে হবে। আমাকে ব্যাংকক যেতে হবে!
আমি যখন ব্যাংকক গেলাম দেখলাম জীবনটা আর আগের মত মজার আর উপভোগ্য নয়। ওখানকার লোকেরা বলছে তোমাকে সফল হতে হলে প্রচুর পড়াশোনা করতে হবে। অর্থোপার্জনের জন্য অনেক খাটতে হবে!আমি কাজ করা শুরু করলাম। দৈনিক ৮ ঘন্টা করে কাজ করতাম। পাশাপাশি ছিল ভার্সিটির পড়াশোনা। এত পরিশ্রমের পরেও দেখা গেল খাওয়ার মেনুতে এক গামলা নুডুলস বা ফ্রাইড রাইস ছাড়া তেমন কিছু জুটছে না। রাত্রে যেখানে থাকতে হত সেটাও ছিল অমানবিক! অনেক মানুষ একত্রে একটা রুমে থাকা, প্রচন্ড গরম! আমি চিন্তা করলাম, এত কষ্ট করার পরেও আমার জীবনে সুখ নাই কেন? আনন্দ নাই কেন? আমি তো কম কাজ করছি না। এর পরেও আমার জীবনের মৌলিক চাহিদাগুলো কেন মিটছে না?
ভার্সিটির পড়াশোনাও আমার জন্য কঠিন হয়ে পড়লো। কারণ সবগুলো ক্লাসই আমার কাছে ছিল বোরিং আর বিরক্তিকর। কোনটাতেই মন বসাতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল প্রতিটা ডিপার্টমেন্টই এক রকম ধ্বংস-যজ্ঞের পণ করে মাঠে নেমেছে। প্রত্যেকেই ধ্বংস করছে পৃথিবীকে। আর্কিটেকচার ডিপার্টমেন্টে বাড়ি বানানো শেখাচ্ছে, ধ্বংস করছে পরিবেশ! আমাদের সুন্দর সুন্দর পাহাড় আর সবুজের সমারোহগুলো কংক্রিটের স্তুপে পরিণত হচ্ছে। কৃষি ডিপার্টমেন্টে শেখাচ্ছে কিভাবে কীটনাশক দিবে, কিভাবে বিষ প্রয়োগ করবে ইত্যাদি! হ্যাঁ এগুলোর সবগুলোই দরকারি, কিন্তু আমি মেনে নিতে পারছিলাম না। আমার কাছে জীবনটা দুর্বোধ্য আর জটিল হয়ে ওঠা শুরু করলো। মানসিক শান্তি তো আগেই উধাও হয়ে গেছে!
আমি চিন্তা করতে লাগলাম, কেন আমি ব্যাংককে এসেছি? আমার জীবনকে সফল করার জন্য? সফলতা কী? আমার জীবনকে আনন্দদায়ক করা নয় কি? আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন কাউকেই দৈনিক ৮ ঘন্টা কাজ করতে দেখি নি। বড়রা সবাই দৈনিক ২ ঘন্টা করে কাজ করত তাও বছরে ২ মাস। এক মাসে ধান চাষ করত আরেক মাসে সেগুলো তুলে গোলায় ভরতো। বাকি ১০ মাস তারা নিজেদের মত করে কাটাতো। উৎসবে মেতে থাকে থাইল্যান্ডের গ্রামগুলো। প্রতি মাসেই কোন না কোন প্রোগ্রাম লেগেই থাকে। কারণ মানুষের হাতে পর্যাপ্ত সময় আছে। এখানকার মানুষ পর্যাপ্ত পরিমানে ঘুমায়। এমন কি দুপুরে খাওয়ার পরে ঘুমানো গ্রামগুলোর নিয়মিত রুটিনের অংশ। দুপুরে ঘুমায়, ঘুম থেকে উঠে গল্প-গুজব করে। গল্পের বিষয়বস্তু হয়ত থাকে ”ভাই তোমার ছেলের বৌয়ের কী খবর? নাতি-নাতনী আছে ভালই? ভাবীর শইলডা ভালা?” মানুষের হাতে অজস্র সময় আছে। এই সময়গুলো তারা নিজেদের জন্য রাখে। নিজেদের মত করে সময় কাটায়। পরিবারের সাথে, আত্মীয়-স্বজনদের সাথে। যখন তাদের হাতে প্রচুর সময় আছে তখন তারা তা ব্যয় করতে পারে নিজেদেরকে বুঝার জন্য। আর যখন একটা মানুষ তার নিজেকে বুঝতে পারে তখন সে দিব্য দৃষ্টি দিয়ে দেখতে পায় ’তার কী কী প্রয়োজন?’ নিজের জীবনের জন্য কারো হয়ত প্রয়োজন সুখ-সমৃদ্ধি, কারো প্রয়োজন ভালবাসা, কারো হয়ত প্রয়োজন জীবনকে তীব্র ভাবে অনুভব করা, এঞ্জয় করা!
তো এমতাবস্থায় মানুষ জীবনের সৌন্দর্যকে উপলব্ধি করতে পারে। আর এই সৌন্দর্য কিন্তু তারা বিভিন্ন ভাবে প্রকাশও করে। দেখবেন কেউ হয়ত তার ছুড়ির কাঠের বাটের উপর নকশা আঁকছে, কেউ হস্তশিল্পের মাধ্যমে বাঁশ বা বেতের ঝুড়ি বানাচ্ছে ইত্যাদি। এই শিল্পগুলো কিন্তু এমনি এমনি তৈরি হয় না। জীবনের সবটুকু রঙ উবে গেলে কিন্তু এই কাজগুলোতে আর প্রাণ থাকে না। এই কাজগুলো করার সময় থাকে না। যেমনটা দেখছি এই ব্যাংকক শহরে।
আমার গ্রাম গ্রামের মতই আছে। সবাই সবার মত করে নিজেদের সময়গুলো নিজেদের জন্য ব্যয় করছে। কিন্তু আমি এখানে পড়ে আছি দৈনিক ৮ ঘন্টা কাজ নিয়ে! আমার সফলতা আমাকে কী দিবে যদি আমার জীবনের আনন্দই কেড়ে নেয়? আমার জীবন এমন কঠিন আর দুর্বোধ্য হয়ে যাচ্ছে, এই জীবন আমাকে কী দিবে? নতুন ভাবে চিন্তা করলাম। এটা বুঝে গেলাম যে আমি ভুল জায়গায় এসেছি। এই ইউনিভার্সিটির পড়াশোনা, ৯টা-৫টা চাকরি এসবে আর পোষাচ্ছে না। পড়াশোনা শিকেয় তুলে ফিরে আসলাম আমার গ্রামে। সেই চির চেনা পরিচিত গ্রাম।
If anybody want to have a choice, you can have a choice. The choice to be easy or choice to be hard, it depend on you. Jon Jandai
ফিরে এসে আমি আমার সেই শৈশবের দিনগুলোর মত করে জীবনকে সাজালাম। বছরে দুই মাস চাষাবাদ করে চার টনের মত চাল উৎপাদন করতাম। ৬ জনের পরিবারের জন্য বছরে আধা টনের মত চাল লাগত। বাকিটা বিক্রি করা হয়। দুইটা পুকুর কাটলাম মাছ চাষের জন্য। বাড়ির পাশে ছোট্ট একটা সবজির বাগান করলাম যেখানে দৈনিক ১৫ মিনিট সময় দেয়া লাগে। আমার ফ্যামিলির জন্য সব মাছ আর সবজি লাগে না। বাকিটা বিক্রি করে আয়ের আরেকটা উৎস বের করা গেল। পুরো পরিবারের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা এভাবে করে ফেললাম।
আমার কাছে জীবনটা এখন খুব সহজ, সিম্পল আর ঝামেলামুক্ত! ব্যাংককে আমি ৭ বছর কী করে কাটিয়েছি? আমি এখানে বছরে দুই মাস চাষাবাদ, দৈনিক ১৫ মিনিট বাগানে সময় দিয়ে ৬ জনের পরিবার খুব ভাল মতই চালাতে পারছি। এই লাইফটা কি ইজি না? আমার অনেকগুলো বাড়ি আছে, প্রায় প্রতি বছরই আমি নতুন বাড়ি বানাই। যে কেউ চাইলেই কিন্তু বাড়ি বানাতে পারে। এমন কি ১৪-১৫ বছরের স্কুলের বাচ্চাও পারে। সে পরিশ্রম করলে মাটি থেকে ইট বানাতে পারবে। সেখান থেকে নিজের থাকার মত বাড়ি বানানো এমন কোন জটিল কিছু না, অন্তত আমাদের গ্রামগুলোর প্রেক্ষাপটে। আমার অনেক বন্ধুরা আছে যারা ক্লাসের ফার্স্ট বয় ছিল। অনেক ভাল চাকরি করে। তারাও বাড়ি করেছে, তাদের চাহিদা মত। এই বাড়ি বানানোর ঋণ তাকে পরিশোধ করতে হবে এর পরের বহু বছর ধরে। আমার চাহিদা কম, আমার জীবনে জটিলতা কম। আমার বাসস্থানের সংস্থান আমি করতে পেরেছি। এটা মানুষের অন্যতম একটা মৌলিক চাহিদা।
মানুষের পরবর্তী মৌলিক চাহিদা হচ্ছে বস্ত্র। আমি চিন্তা করলাম যে, আমাকে এভাবে থাকলে চলবে না। ফিটফাট হয়ে থাকতে হবে। দেখলাম সিনেমার নায়কদের ছবি। দুই মাস খেটে টাকা জমিয়ে তাদের মত টাইট জিন্স প্যান্ট কিনে পড়লাম। আয়নায় ঘুরে ফিরে নিজেকে দেখে চিন্তা করলাম এই প্যান্টটা আমাকে নতুন কী দিয়েছে? আমার জীবনে কোন পরিবর্তন এনেছে কি? আমাকে কেন এমন খরচ করে আরেকজনের মত হতে হবে? আরেকজনকে কেন ফলো করতে হবে নিজেকে ফ্যাশনেবল প্রমাণ করার জন্য? একটা জামা বা অন্য কিছু কেনার সময় আমি চিন্তা করি আমি এটা কেন কিনছি? এটা আমার পছন্দ তাই কিনছি নাকি এটা আমার প্রয়োজন? যদি আমার পছন্দের জন্য কিনে থাকি তাহলে সেটা ভুল! আমার উচিত আমার প্রয়োজন মেটানো। কাপড়ের ব্যাপারে মজার ব্যাপারটা হচ্ছে আমাকে কখনোই জামা-কাপড় কিনতে হয় না। আমার সাথে যারা দেখা করতে আসে তারাই কাপড়-চোপড় দেয়। যদি পুরোনো কাপড় পড়া থাকি তাহলে আরো বেশি দেয়। ফলে এই এত্ত এত্ত কাপড় আমাকে আবার অন্য মানুষের মাঝে বিলাতে হয়।
শেষের দরকারি জিনিসটা হচ্ছে ওষুধ। যদি আমি অসুস্থ্য হই তাহলে কী হবে? যেহেতু আমার সেরকম কোন নগদ অর্থ নিয়মিত আয় হয় না তাই ভয়েই ছিলাম। পরে ভাল করে চিন্তা করে দেখলাম অসুস্থ্যতা খুব একটা খারাপ জিনিস না। এটা আমাদের জন্য ভাল। এই অর্থে ভাল যে আমরা আমাদের ভুলগুলো এর মাধ্যমে শিখতে পারি। সাধারণত অসুখের ক্ষেত্রে এমনটাই হয় যে আমাদের কোন একটা ভুলের জন্য এটার সৃষ্টি হয়। যেমন বৃষ্টিতে বেশি ভিজলে ঠান্ডা জ্বর হয়, পচা-বাসী খাবার খেলে পেটে সমস্যা হয় ইত্যাদি। তো কোন কাজটা করা যাবে আর কোনটা করা যাবে না সেটা শিখে ফেললাম। শিখে ফেললাম জল চিকিৎসা। পানি দিয়ে কিভাবে রোগ সারানো যায়। প্রাকৃতিক উপাদানের মাধ্যমে কিভাবে নিজের চিকিৎসা করা যায়। এভাবে একে একে আমার সবগুলো মৌলিক চাহিদা পূরণ করলাম।
এখন দেখছি আমার আর কোন দুশ্চিন্তা নাই। আগে যেমন আকাশচুম্বী চাওয়া-পাওয়ার একটা হিসেব করা লাগত এখন সেটা লাগে না। এখন আমি মুক্ত! আমি স্বাধীন! মানুষ আমাকে পাগল ভাবুক আর যাই ভাবুক, আমি সম্ভবত পৃথিবীর একজন ইউনিক মানুষ। আমাকে কারো অনুকরণ করতে হয় না। আমাকে কারো মত হতে হয় না। আমি আমার মতই!
আমার এই প্রচুর অবসরে শুরু করলাম Pun Pun নামক একটা প্রতিষ্ঠান। এটা বীজ সংরক্ষণাগার হিসেবে কাজ করে। মানুষের টিকে থাকা বা একটা সভ্যতা টিকে থাকা আরো বড় করে বলতে একটা জীব জগতকে টিকিয়ে রাখার জন্য খাবার দরকার। আর খাবারের জন্য দরকার বীজ। আমরা এই বীজের উপরই কাজ করি। একই সাথে ’নিজেকে জানা’র জন্য একটা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র করেছি। যেখানে আমরা শিক্ষা দেই কিভাবে জীবনে সুখী হওয়া যায়। একটা সময় মানুষ ভাবতো টাকার কাছেই সুখ আছে। আমরা এই ভাবনাটাকে ঘুরিয়ে দিচ্ছি। টাকার কাছে নয়, বরং সুখ আছে তোমার নিজের কাছে। তুমি তোমার মধ্যে ফিরে আসো। তুমি তোমার নিজেকে চেনো, তুমি সুখী হবে। তোমার জীবন সহজ হবে।
প্রাণী জগতের দিকে তাকাও। একটা পাখি সারা বছর বাসা বানায় না। অল্প কিছু দিন নির্দিষ্ট এই কাজটি সে করে। এরপর সে কিন্তু উড়ে বেড়ায়। প্রয়োজন যতটুকু ততটুকু খাবার সংগ্রহ করে। নিজেকে সময় দেয়। খেয়াল খুশি মত গান গায়, ডেকে বেড়ায়। বাচ্চাদেরকে উড়া শেখায়। তাদের মত হও! জীবনকে শুধুমাত্র টাকার পিছনে ছুটিয়ো না। জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য টাকা আর ভোগ বিলাসকে করো না। পার্থিব জগতের বাইরের অপার্থিব একটা জগত আছে। সেটা নিয়ে চিন্তা করো। তোমাকে কেন পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে সেটা চিন্তা করো। সৃষ্টিকর্তা তোমাকে কি এমনি এমনি বানিয়েছেন? নাকি তোমার উপর কোন দায়িত্ব-কর্তব্য দেয়া হয়েছে এই পৃথিবীর জন্য এই সমাজ-সভ্যতার জন্য? এটা নিয়ে ভাবো। চতুর্দিকের হতাশা, অবসাদ থেকে মুক্ত থাকতে পারবে। কে কী চিন্তা করছে সেটা ভুলে যাও। বেঁচে থাকো শুধু তোমার জন্য!