-তোমার কি চাকরিবাকরি কিছুই করতে ইচ্ছে করে না?
রীতিমতো মারমুখী হয়ে জিজ্ঞেস করল আনিলা। চুপ করে বসেছিল এতক্ষণ দুজনে। কথা যেন কিছু মনেই আসছে না। অবশেষে মনস্থির করে বলল ও।
-চাকরি খুব কম মানুষই ইচ্ছে করে করে। আমি তাদের মধ্যে না।
-আমার প্রশ্নের উত্তর হয়নি এটা।
সস্তার সিগারেটে আগুন দিল শুভ। লম্বা একটাটান দিয়ে ধোয়া ছেড়ে বলল,
-আমি মনের বিরুদ্ধে কিছু করিনা। চাকরিটাতে আমার মনের সায় পাচ্ছি না। যদি পেতাম তাহলে ছাড়ার ডিসিশন নিতাম না।
-মনের বিরুদ্ধে মাঝেমাঝে অনেক কিছুই করতে হয়। বাবা আমার বিয়ের জন্যে উঠে পরে লেগেছেন। আমার কেউ পছন্দের আছে নাকি জিজ্ঞেসও করেছেন। আমি এখন তোমার কথা কোন মুখে বলবো? কিভাবে বলব?
-খুব সহজ। বলতে চাইলে বলবে একটা বেকার, বাউন্ডুলে ছেলেকে তোমার পছন্দ আছে। তাকে তুমি বিয়ে করতে চাও।
-এতটাই সহজ? বাবা মেনে নেবে? কোন সুস্থমস্তিষ্কের বাবা তার মেয়ের জন্য এমন পাত্র পছন্দ করবে?
সিগারেটটা ছুড়ে ফেলে দিল শুভ। বিস্বাদ লাগছে।
-পছন্দ করবে নাকি সেটা তো আমি বলতে পারবো না। তবে যেটা সত্যি তাই তোমাকে বললাম।
ঘুরে বসে আনিলার চোখে তাকাল শুভ,
-দেখ, আমার পক্ষে এখন সহসাই কিছু করা সম্ভব হবেনা। চাকরিটা যদি আমি নাও ছাড়ি, ওরাই আমাকে ছড়িয়ে দেবে যে কোন দিন। আমার মন বসছে না এসব কাজে। এখন তোমার হাতে তুমি কি করতে চাও তা। তবে জেনে নিও তুমি যাই ভেবেচিনতে ঠিক করবে, আমি তাই মেনে নেবো। হয়তো দুঃখ থাকবে মনে, কিন্তু আক্ষেপ থাকবে না ঠকানর।
কিছু না বলে উঠে রওনা হল আনিলা। ও চায়না ওর চোখের পানি শুভ দেখতে পাক।
অনার্সের তৃতীয় বত্সরে পড়ার সময় নবাগতদের বরণের দিনে স্টেজে আবৃত্তি করেছিল শুভ। নবাগতা আনিলা তখন বেশ গুটিসুটি মেরে ভিড়ের এককোণে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিল। অমন ভারী, দরাজ গলার কাজী নজরুলের কবিতা যেন একদম বুকের ভেতরে কম্পন তুলছিল ওর। প্রেমে পরে গিয়েছিল সেদিনই। বুঝতে পারেনি। তারপর দিনের পর দিন পেরিয়েছে। আনিলা খুজে বের করেছে শুভর জীবন বৃত্তান্ত। ব্রোকেন ফ্যামিলির ছেলে, ভার্সিটির রুলিং দলের একজন নেতা, প্রবল স্বাধীনচেতা, সাহিত্যমনা। আড্ডা, ডিপার্টমেন্ট সব জায়গার প্রাণ যেন ও। নিজের চারপাশে একটা অদৃশ্য মন্ত্রের মত বলয় দিয়ে ঘিরে রাখা ওর। প্রবল ব্যক্তিত্বের অধিকারী হলেও তার ভারে নুয়ে পরে না। যেন একজন বর্ণ লিডার।
এমন এক মানুষের সাথে নিজেকে কল্পনা করতেও ভয় লাগে আনিলার। কিন্তু নিজের ভিতরে ওর প্রেমে পরে সকল বাধ ভেঙে পড়ছিল সেই স্রোত।
সাহিত্যসভার মাসিক আড্ডা হতো তখন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে সবচেয়ে পুরোনো বটগাছতার বেদীতে। সভাপতি থাকতো শুভ। একদিন সেই সভায় হাজির হল আনিলা। আজ সে প্রস্তুত। সে জানেনা কিভাবে কি করবে। তবে কিছু একটা না করে, শুভর প্রতি ওর যে ভালবাসার জন্ম নিয়েছে তা ওকে না জানিয়ে থাকতে পারল না কিছুতেই।
এটা সেটা আলোচনার পর নতুনদের সাথে পরিচিতি পর্ব শুরু হল। আনিলা নিজের নাম, ডিপার্টমেন্ট জানালো। ও কবিতা লিখে শুনে সবাই ওকে বলল একটা আবৃত্তি করতে। আনিকা হেসে জানালো আবৃত্তি ওর আসে না। তবে অনুমতি মিললে ও নিজের লেখা একটা কবিতা যা ও গানে রূপ দিয়েছে, গেয়ে শুনাতে পারে। সবাই সম্মতির হুল্লোড় তুলল। আনিলার নজর আটকে ছিল শুভর দিকে। সেও আনিলার গান শোনার জন্য নড়েচড়ে বসল। আনিলা একটা মুহূর্ত অপেক্ষা করে ওর ভেতরের সেই প্রেমের অনুভূতিটাকে স্পর্শ করে নিল যেন। তারপর সবটা দরদ ঢেলে গাইল,
‘আমার সুখের তরী হানিল তার জোয়ার,
আমি তার ’পরে রাখিনু আমার জীবন ধার
সে আমায় ভাসায় নিদ্রা-বিনিদ্রায়
আমার সকল সময়-স্বপন করে নিল তার’
তন্ময় হয়ে শুনে গেল সবাই। আনিলার গান থামার পরেও কেউ কিছুক্ষণ কোন কথা বলতে পারল না। তারপর একজন-দুজন করে করতালিতে ফেটে পড়ল। আনিলা চোখ বুজে গাইছিল গান। চোখের কোণে অশ্রুর ছোয়া যেন আর্জি হয়ে বেরিয়ে এসেছিল। চোখ চুলে শুভ যেদিকে বসেছিল তাকাল, কিন্তু কাউকে দেখল না। কখন সে উঠে সরে পড়েছে কেউ জানেনা। কান্না রোধ করে চলে এসেছে সেখান থেকে আনিলা।
পরের কয়েকদিন ঘর থেকে বের হল না আনিলা। ইউনিভার্সিটি, গানের ক্লাস, বন্ধুদের আড্ডা, বিকেলে পার্কে বেড়ানো কোনটাই না। এমনকি নিজের বারান্দায় যত্ন করে গড়ে তোলা বাগানটাতেও গেল না প্রতিদিন ভোরে পানি দিতে। মার তীক্ষ্ন চোখের দৃষ্টি কোনোরকমে এড়িয়ে ঘরেই খাবার এনে খেতে লাগলো।
ঘুরে ফিরে ওর কেবল সেদিনের কথা মনে আসছে। শুভ কি বুঝেনি ওর মনের আকুতি? তা কি করে সম্ভব? মনের যে টান ও সুরে উন্মুক্ত করে দিয়েছে তা পাষাণ ছাড়া আর কে অবহেলা করতে পারে? নাকি শুভ বুঝতে পেরে এভাবে অসম্মতি জানালো? কিছুই বুঝতে পারছে না আনিলা। ওর চেহারায়, চোখে বর্ষাকাল শুরু হয়েছে। মেঘরঙঅন্ধকার আর যখন তখন ভেজা বর্ষণ।
রবিবার রীতিমত বাধ্য হয়েই ঘর থেকে বের হল আনিলা। পরীক্ষা আছে আজকে, যেতেই হবে। নিজের সাজগোজের দিকে কোন খেয়াল করেনি ও। টিপটাও যে বাকা পড়েছে তাও যেন চোখে পরেনি। বাসে বসে আনমনে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বসেছিল। কিছুই পড়া হয়নি। তারপরও এটেন্ড করার জন্যেই যাওয়া। বাস থেকে নেমে রিকশা নিল। ডিপার্টমেন্টের সামনে রিকশা থেকে নেমে ভীষণ অবাক হল। সব ছেলেমেয়েই বাহিরে। কি ব্যাপার? পরিচিত এক ক্লাসমেটকে ডাক দিল আনিলা।
-কি ব্যাপার? তোমরা হলে না গিয়ে বাহিরে কেন?
ক্লাসমেট খুশিখুশী গলায় বলল,
-পরীক্ষ্া হবে না। ক্যানসেল।
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল আনিলা,
-ক্যানসেল মানে?
-ক্যানসেল মানে ক্যানসেল, শুভ ভাইয়েরা হল উঠিয়ে দিয়েছে।
অন্য আরেক বন্ধু ডাকতে সরে পড়ল ছেলেটা। আনিলা কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না। থেকে থেকে ওর রাগ হচ্ছে ভীষণ শুভর উপর। ওকে ফিরিয়ে দিয়ে এখন পরীক্ষাও দিতে দেবে না? কি পেয়েছে টা কি! যা ইচ্ছে তাই?
রেগে বের হয়ে এল আনিলা। ডিপার্টমেন্টের পিছনের বাগানে ভিড় থাকেনা। ওখানে পায়চারি করতে লাগলো। শুভকে কিভাবে শায়েস্তা করা যায় ভাবছে। ‘নাহ! এই ছেলেকে এতো ভালবাসা উচিত হয়নি। ওর কোন অধিকার নেই আমার মনে স্থান গড়ার।’
একটা পাথর তুলে ছুড়ে মারল ও অদৃশ্য শুভকে উদ্দেশ্য করে যেন।
-নাইস থ্রো!
পেছন থেকে আওয়াজ আসল। চকিতে ঘুরে তাকাল আনিলা। ডিপার্টমেন্টের পাশ ঘুরে এদিকেই আসছে শুভ। হাসছে আনিলার দিকে তাকিয়ে। গায়ে একটা গাঢ় নীল রঙের চাদর অযত্নে ঢেকে রাখা।
ওকে দেখে মনে তোলপাড় শুরু হচ্ছিল আনিলার। অনেক কষ্টে সামাল দিল। কাছে এসে দাড়াতে বলল,
-পাথরটা ছোড়ার আগে আপনাকে দেখতে পেলে ভাল হত। লক্ষ্য ব্যর্থ হত না।
কথাটা বলে হনহন করে চলে যাচ্ছিল আনিলা শুভকে পাশ কাটিয়ে। হঠাৎ এক হাত বাড়িয়ে ওকে ধরে ফেলল শুভ। আনিলার হার্টবিট ভীষণভাবে বেড়ে গিয়েছে ঐ স্পর্শে। কোনমতে ঘুরে তাকাল ও। শুভর গা থেকে চাদরটা সরে গিয়েছে অনেকটাই। একটা হাত প্লাস্টার করা দেখা যাচ্ছে। সেই হাতেই এক গুচ্ছ টিউলিপ।
সেদিন এক হাটুতে বসেনি শুভ। কেবল নিজের সবচেয়ে প্রিয় ফুলগুলো আনিলার হাতে দিয়ে যেন সমর্পণ করেছিল একটা বন্য হৃদয়। যে হৃদয় প্রতিনিয়ত আনিলার পরে ঘুরে ফিরে যায় সুরের সন্ধানে।
রিকশায় বসে কাদছে একটা মেয়ে। চোখের পানি কাজলের সাথে মিশে কালো রঙ ধরেছে। রিকশাওয়ালা বোধহয় এসব দেখে অভ্যস্ত। শত হলেও সোহরাওয়ার্দী, শাহবাগ এরিয়ায় রিকশা চালায়। সামনে একটা পরিচিত দৃশ্য দেখে হাসল রিকশাওয়ালা সবুজ। একটা ছেলে পাগলের মত ছুটে আসছে পাশের গলিটা থেকে বের হয়ে। ওর দিকে হাত নাড়ছে থামানোর জন্য। পেছন থেকে মেয়েটা কান্নামেশানো ভেজা স্বরে মানা করল,
-থামবেন না মামা। চালান, চালাতে থাকেন। ওকে আমি চিনি না। কেউ না ও আমার।
সবুজ মুচকি হাসল। রিকশা থামাল না। তবে গতিতে একটু শিথিলতা আনল যাত্রীর অজান্তে।
সন্ধাবেলায় একটা রিকশা যাচ্ছে ঢাকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের রাস্তায়। একটা মেয়ে রিকশায় বসে কাদছে। তার গালে কাজল ধোয়া পানির ছাপ। রিকশার পেছনে পেছনে একটা ছেলে দৌড়াতে দৌড়াতে আসছে… আর একটু, এরপরই সে রিকশাটাকে ধরতে পারবে। আরেকটু চাই ছুটে চলা…..
লিখেছেনঃ বিষাক্ত অর্কিড