চাট্টানুগা: দূষিত শহর থেকে সবচেয়ে সবুজ শহর হওয়ার গল্প

4361
0

একসময় পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত শহরগুলোর মধ্যে একটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের চাট্টানুগা, যা এখন পৃথিবীর সবুজ শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম। এটা কিন্তু একদিনে বা এমনি এমনি সম্ভব হয়নি। অনেক সময় সাধারণ মানুষের কাছে মনে হয়, পরিবেশ দূষণ একটি দেশের সরকার যদি চায় খুব সহজেই কমিয়ে আনতে পারে। এই কাজ শুধুমাত্র সরকারের নিজস্ব, জনগণের এখানে কোনো দায়িত্ব নেই। অথচ সাধারণ মানুষের অসচেতনতার জন্যই কিন্তু দূষণ হয়। কিন্তু চাট্টানুগাকে দূষণমুক্ত করার জন্য এগিয়ে এসেছে সেখানকার সাধারণ মানুষ, স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি এবং সেখানকার ব্যবসায়ীরা। তাদের সম্মিলিত চেষ্টায় বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়া একটি এলাকা নতুন করে জীবন পেয়েছে। এমন সময়ও এসেছে যে, Environmental Protection Agency (EPA) ঘোষণা দিয়েছিলো যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে দূষিত শহর হচ্ছে চাট্টানুগা।

চাট্টানুগার একটি পার্ক; Image Source: Hargreaves Associates

ইপিএ শুধু নয়, ১৯৬০ সালের দিকে যুক্তরাষ্ট্র সরকার থেকেও ঘোষণা আসে যে চাট্টানুগা ধীরে ধীরে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে সেখানকার বাতাস ছিল সবচেয়ে বেশি দূষিত। এই শহরে ছিল প্রচুর স্টিল তৈরির কারখানা। এমনকি অনেক ধরনের শিল্প কারখানাও ছিল যেখানে কোক ওভেন ব্যবহার করা হতো। এসব কারখানা থেকে ধোঁয়া বের হয়ে সেখানকার বাতাসকে পুরোপুরি দূষিত করে ফেলে। এই দূষণ এতটাই প্রকট ছিল যে দুপুরবেলা ঝলমলে রোদের মধ্যেও গাড়ির লাইট জ্বালিয়ে চালকদের গাড়ি চালাতে হতো।

শুধু বাতাস নয়, পানিও দূষিত ছিল এই শহরের। এই শহরের ভিতর দিয়ে চলে গিয়েছে টেনিসি নদী। এই নদীর চারদিকে গড়ে উঠেছিল কলকারাখানা। এসব জায়গা থেকে সব ধরনের ময়লা আবর্জনা, বিষাক্ত শিল্পবর্জ্য এখানে ফেলা হতো। এরকম অবস্থায় শহর বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়াতে সেখানকার মানুষ এই জায়গা ছেড়ে চলে যাচ্ছিলো। আর পেছনে পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে থাকে বিষাক্ত পদার্থে পরিপূর্ণ বর্জ্যভূমি। একটা সময় এমন এসেছিল যে সেখানে প্রচুর কলকারখানা ছিল কিন্তু কোনো মানুষ ছিল না, প্রচুর বাসাবাড়ি ছিল কিন্তু বসবাসের যোগ্য মানুষ কমে আসছিলো, যে কারণে উৎপাদন না হওয়ার কারণে বেকারত্ব বেড়ে গিয়েছিল এবং শহর ধীরে ধীরে অপরাধীদের আশ্রয়স্থল হয়ে পড়েছিল। অর্থাৎ একটি পরিত্যক্ত জায়গা হওয়ার সবধরনের গুণই ছিল এই শহরের।

একসময় পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত শহরগুলোর মধ্যে একটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের চাট্টানুগা; Image Source: DetailXPerts

যখন ধীরে ধীরে এমন হওয়া শুরু হলো, তখন নিজের শহরকে বাঁচাতে কিছু মানুষ এগিয়ে আসে। ১৯৮৪ সালে শহরের সরকারি কিছু কর্মকর্তা মিলে সিদ্ধান্ত নেন, তারা যেভাবেই হোক তাদের চাট্টানুগা শহরকে দূষণমুক্ত করবে এবং শহরের পরিবেশ বসবাসের যোগ্য করে তুলবেন। তারা একটি প্রক্রিয়া শুরু করলেন, যেটা ছিল চাট্টানুগাতে যারা বসবাস করছিল তাদের নিয়ে প্রতি সপ্তাহে জরুরি সমাবেশ করা। এই প্রক্রিয়ার নাম তারা দিয়েছিলেন Vision 2000। প্রায় বিশ সপ্তাহ ধরে তাদের এই সমাবেশ প্রক্রিয়া চলতে থাকে। সেখানে প্রায় ১৭০০ চাট্টানুগা নাগরিক যোগদান করে এবং শহরের প্রধান সমস্যাগুলো বের করে। বিষয়টি অনেকটা ফোকাস গ্রুপ ডিসকাশনের মতো। সমস্যা চিহ্নিত করার পর তারা কিছু লক্ষ্য ঠিক করেন যে কীভাবে এই সমস্যাগুলোর সমাধান করা হবে। এই সমাবেশ ও শহরের সবাইকে নিয়ে একত্রিত হওয়ার ফলে বিভিন্ন চিন্তাভাবনা সামনে আসে। অনেকটা ব্রেইনস্ট্রমিং করে সমস্যাগুলোর প্রায় হাজার রকমের সমাধান বের হয়েছিলো। শহরের দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্য ছিল সবধরনের সমাধানের ব্যবস্থা করা।

চাট্টানুগা এখন; Image Source: EconomicDevelopment.org

১৯৯৫ সালের মধ্যে প্রায় ১১ বছরের ব্যবধানে চাট্টানুগা তাদের ভিশন ২০০০ এর অনেকটাই পূরণ করতে পেরেছিলো। সেখানকার কলকারখানাগুলোর লক্ষ্য ছিল যেন তাদের কারখানা থেকে “শূন্য নির্গমন” হয়। শহরে যেসব পাবলিক বাস ডিজেলে চলতো সেগুলো থেকেও যেন কম দূষিত বাতাস নির্গমন হয় সেদিকে তাদের লক্ষ্য ছিল। কিছুদিন পরেই তারা তড়িৎচালিত গাড়ি তৈরির দিকে মন দেয় এবং তাদের রাস্তায় এ ধরনের গাড়ি চলাচলের ব্যবস্থা করে।

চাট্টানুগা শহরে অভিনব প্রক্রিয়াজাতকরণের ব্যবস্থা করা হয়। তারা আবর্জনা পুনরায় ব্যবহার করার জন্য এসবের প্রক্রিয়াজাতকরণের ব্যবস্থা করে। ১৯৮৯ সালের দিকে সেখানে একটি অবকাঠামো নির্মাণের প্রস্তুতি চলছিলো যার উদ্দেশ্য ছিল ময়লা আবর্জনাগুলো সেখানে এনে পুড়িয়ে ফেলা। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় ইন্সিনারেশন। এই প্রক্রিয়া যদি চলতে দেয়া হতো তাহলে চাট্টানুগার বাতাসে দূষকের পরিমাণ অসম্ভব বেড়ে যেত, কিন্তু এই অবকাঠামো নির্মাণে বড় বাধা দেয় সেখানকার মানুষ। তখন থেকে প্রায় সাত ধরনের পরিবেশের ক্ষতিকারক দূষকের পরিমাণ চাট্টানুগার বাতাস থেকে কমে গিয়েছে। এমনকি সেখানকার ফেডারেল সরকার এ সমস্ত দূষকের যে সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে টেনিসির আকাশে তা থেকেও কম পরিমাণে এসব দূষক অবস্থান করছে।

Image Source: SecureWaters

আরেকটি অভিনব উপায় তারা অবলম্বন করেছিলো। সেটা হচ্ছে কম আয় করা গৃহায়ন এবং ভাড়া দিয়ে থাকা যায় এ ধরনের বাড়িগুলোকে নতুন করে পরিবেশবান্ধব উপায়ে নকশা করে সাজানো। এছাড়া চাট্টানুগাতে তৈরি করা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক পরিষ্কার পানির একুরিয়াম। নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে এই একুরিয়াম ছিল পর্যটকদের ভ্রমণের অন্যতম আকর্ষণ। টেনিসি নদীর দু’পাশ দিয়ে তারা রিভারফ্রন্ট পার্ক নামক একটি উদ্যান তৈরি করে, যেখানে প্রতি বছর প্রায় এক মিলিয়ন পর্যটক ভ্রমণে যায়। এর ফলে এই জায়গার দামও দিন দিন বাড়তে থাকে। চাট্টানুগা শহরের কেন্দ্রবিন্দুতে এসব তৈরি করার ফলে যেসব নাগরিক একসময় চলে গিয়েছিল, তারা আবার ফিরে আসে।

Image Source: hargreaves.com

সকলের সম্মিলিত দায়িত্ব কাঁধে নেয়ার ফলেই কিন্তু এরকম দূষিত শহরকে পুনরায় বসবাসের উপযোগী করা গিয়েছে। তা না হলে কখনই তা সম্ভব ছিল না।

কয়েকটি বিষয় এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয়। যেমন-

– একসাথে কাজ করার ফলে ২০০০ সালের মধ্যে দূষণ দূর করার যে লক্ষ্য তৈরি করা হয়েছিলো, অনেক আগেই তারা সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে পেরেছে।

– এই সময়ের মধ্যে কোনোভাবেই সেখানকার মানুষ পরিবেশ দূষণকে প্রশ্রয় দেয়নি।

– সকলে একসাথে কাজ করেছে বিধায় শহরের দূষণ রোধ করার জন্য যে যে সমাধানের কথা প্রস্তাব করা করেছে সেগুলো খুব তাড়াতাড়ি বাস্তবে প্রয়োগ করা গিয়েছে।

– দূষণ রোধ করার সঙ্গে সঙ্গেই চাট্টানুগার আর্থ-সামাজিক অবস্থা আগের থেকেও ভালো এবং উন্নত হয়ে পড়ে।

– চাট্টানুগার মানুষজন দূরদর্শিতার প্রমাণ দিয়েছে। তারা পুরো শহরকে এমনভাবে ঢেলে সাজিয়েছে যাতে করে ভবিষ্যতে এই শহরকে পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় হিসেবে তুলে ধরা যায়।

Image Source: CompassTwine

একটি বিশেষ দিক এখানে লক্ষণীয়। একটি দেশের অর্থনীতি এবং রাজনীতিকে যদি একটি মূল্যবান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যায় তাহলে যেকোনো সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। কারণ যেকোনো কিছুর পরিবর্তন অর্থনীতির সাথে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। আবার কোনোকিছু পরিবর্তনের জন্য যে অনুমতি এবং লোকবলের প্রয়োজন সেটা রাজনৈতিক সাহায্য ছাড়া কখনোই সম্ভব নয়। এর সাথে আরেকটি বিষয় যোগ হয়েছে- নৈতিকতা। মানুষ যদি নীতিগত এবং দৃঢ়ভাবে নিজের লক্ষ্যের দিকে ছুটে যায় তাহলে কোনো কাজই অসম্ভব নয়। চাট্টানুগার মতো একটি দূষিত শহরকে বাঁচানো গিয়েছে শুধুমাত্র সম্মিলিত চেষ্টার জন্য। এই সম্মিলিত চেষ্টার মধ্যে কোনো রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক বাঁধা আসেনি। প্রত্যেকে নিজেদের নৈতিকতাবোধ থেকে কাজ করেছে এবং তার ফল পেয়েছে। আমাদের দেশের বড় বড় কিছু শহর দূষিত সীমার কাছাকাছি বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে হয়তো সীমা অতিক্রম করেও গিয়েছে। আমরা চাট্টানুগা শহরের দূষণমুক্ত হওয়ার গল্প থেকে শিক্ষা নিতে পারি।

লেখাঃ Soumik Nafis Sadeekসূত্রঃ রোয়ার মিডিয়া।