খোজা বৃত্তান্ত: অটোমান রাজপ্রাসাদে খোজাদের প্রভাব

5329
0
অটোমান তোপকাদি প্রাসাদ; Source: Wikimedia

১. অটোমান সাম্রাজ্যের জৌলুসময় রাজপ্রাসাদ তোপকাদিতে ইদানিং খোজাদের চাহিদা বেড়ে গেছে। হেরেম এবং প্রাসাদের অভ্যন্তরে বিবিধ প্রয়োজনে কিছুসংখ্যক খোজাদের নিয়োগ না দিলেই নয়। তাই ইব্রাহিম পাশা সুদান থেকে কিছু কৃষ্ণাঙ্গ কিশোরদের ধরে নিয়ে এসেছেন। সুলতান অনুমতি দিলেই যথাযথ বাছাই প্রক্রিয়া শেষ করে হেরেমের জন্য তাদের মনোনয়ন দিয়ে দিবেন।

২. মুসা এখানে একা নয়, আরো ২০-২৫ জন সুদানি কিশোরও তার সাথে রয়েছে। আছে আরো ভিনদেশী সাদা চামড়ার সুদর্শন কিছু কিশোর। তারা কেউ জানে না কিজন্যে তাদের এখানে নিয়ে আসা হয়েছে ।

৩. বিকেলের দিকে মুসার পাশের শ্বেতাঙ্গ ছেলেকে রাজকীয় কর্মচারীরা এসে ধরে নিয়ে যায়। উড়ো খবর অনুযায়ী শুনা যাচ্ছে তাদের নাকি খোজা বানানোর জন্য নিয়ে আসা হয়েছে এখানে। এ খবর শুনে কিশোর শিবিরে আতংক ছড়াতে লাগল। মুসা হতভম্ব । হয়তো একটু পরেই তার ডাক পড়বে।

মানচিত্রে অটোমান সাম্রাজ্য
Source: Encyclopedia Britannica

প্রাচীন ও মধ্যযুগে রাজপ্রাসাদ ও হেরেমের অভ্যন্তরীণ কাজে এমনিভাবেই কিছু বাছাইকৃত কিশোরদের অণ্ডকোষসহ শুক্রথলি কেটে ফেলে নপুংসক করে দেয়া হত। হেরেমের নারীদের কাজে নিয়োজিত এসব খোজাদের পুরুষাঙ্গ না থাকার কারণে নারীদের সাথে সম্পর্কের অনর্থক ঝুঁকিও ছিল না। যার কারণে হেরেমের ভেতরে তাদের অবাধ যাতায়াত নিয়ে দুশ্চিন্তা পোহাতে হত না। আর এর জন্য এই বিশেষ শ্রেণীর পুরুষদের চাহিদা দিনদিন বাড়তে থাকে৷ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্য অটোমান সালতানাতেও এর ব্যতিক্রম ছিল না। অটোমান রাজপ্রাসাদে খোজাদের ভূমিকা এতই বিস্তৃত ছিল যে, কোন কোন খোজা সাম্রাজ্যে সরাসরি প্রভাব খাটাতে পারতেন। এমনকি সুলতানের সিদ্ধান্তেও তাদের প্রভাব খাটানোর নজির দৃশ্যমান ছিল। অটোমান সাম্রাজ্যে খোজাদের আদিঅন্ত-ই তাহলে জানা যাক।

অটোমান হেরেমে দুই ধরণের খোজার অস্তিত্ব বিদ্যমান ছিল। কালো খোজা ও সাদা খোজা এ দু দলে ভাগ হয়ে হেরেমের প্রশাসনিক দিক দেখভাল করত একজন প্রধান খোজা। আর প্রধান খোজার অধীনে বাদবাকি খোজা বার্তা বহন, গৃ্হস্থালি কাজ এবং সুলতানের আত্মীয়দের বিভিন্ন কাজে সাহায্য করত। কালো খোজাদের মধ্যে প্রায় সবাই ছিল সানদালি৷ যাদের পুরুষাঙ্গ ও অণ্ডকোষ সম্পূর্ণ ছেদ করে দেয়া হত তাদেরকেই মূলত বলা হয়  Sandali. যার জন্যে এই কালো খোজাদের হেরেমে অবাধ যাতায়াত স্বীকৃত ছিল। সাদা চামড়ার খোজাদের পুরুষাঙ্গের অংশবিশেষ রেখে দেয়া হত, ফলে এরা সরাসরি হেরেমের ভেতরে কাজ কর‍তে না পারলেও সেক্রেটারিয়েল কাজ করার সুযোগ পেত। সাম্রাজ্যের প্রাদেশিক শাসনকর্তারা প্রায়শই সুলতানকে পুরস্কার হিসেবে খোজা প্রেরণ করতেন। অটোমান রাজপ্রাসাদ ও হেরেমে প্রায় ৭০০-৮০০ খোজা বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত থাকত। মধ্যযুগে মুসলিম এবং তুর্কি রাষ্ট্রগুলোতে উপঢৌকন হিসেবে খোজা প্রেরণ করা শুরু করেন অটোমান সুলতান প্রথম মেহমেদ। এর পরে মেহমেদের উত্তরসূরিরা এই প্রথা অক্ষুণ্ণ রাখেন। অটোমান রাজপ্রাসাদে খোজা আনা হত সাধারণত সুদান থেকে।

অটোমান তোপকাদি প্রাসাদ; Source: Wikimedia

হেরেমে খোজাদের প্রভাব

খোজা বানানোর পর প্রত্যেক খোজাদের এক বিশেষ প্রশিক্ষণের ভেতর দিয়ে যেতে হত৷ তারপর যোগ্যতা অনুসারে তাদেত কাজ বণ্টন করে দেয়া হত। হেরেমের প্রতিষ্ঠান, খোজা এবং নারীদের দেখভালের জন্য নিয়োজিত থাকতেন একজন প্রধান খোজা। তুর্কি ভাষায় যাদের বলা হত কিজলার আগাসি বা প্রধান কালো খোজা। তিনি মূলত ছিলেন হেরেমের নারীদের প্রধান বা মাস্টার। খোজাদের প্রধান কাজ ছিল যে সমস্ত কোয়ার্টারে নারীরা বাস করেন তাদের দেখাশোনা করা।

১৭ ও ১৮ শতকে কোন কোন খোজা খুব শক্তিশালী হয়ে উঠেছিলেন। প্রভাবশালী এসব খোজারা সুলতানের সাথে সরাসরি সাক্ষাতও করতে পারতেন। এমনকি কোন খোজা প্রধানদের সুলতানের পরিবারে প্রবেশের অধিকার ছিল। প্রধান কালো খোজা অনেকসময় উজিরের অনুপস্থিতিতে দ্বিতীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। উজির যদি কোন কাজে বাইরে অবস্থান করতেন কিংবা সেনাবাহিনী নিয়ে দরবার থেকে দূরে অবস্থান করতেন তখন প্রধান খোজাই তার হয়ে দায়িত্ব পালন করতেন৷ প্রধান খোজা সুলতানের ঘুমাবার কক্ষেও প্রবেশ করতে পারতেন৷ এমনকি প্লাস আল্ট্রা অর্থাৎ হেরেমের নারীদের শোয়ার কক্ষেও তার অবাধ প্রবেশাধিকার ছিল৷ প্রধান কালো খোজা কখনো কখনো সেনাবাহিনীর বিশেষ ইউনিট হালবারডিয়াস এর নেতৃত্ব দিতেন। অটোমান সাম্রাজ্যের জেনারেল বা গভর্ণর মর্যাদার পদ পাশা তেও অনেক খোজাদের নিয়োগ দৃশ্যমান ছিল।

একজন কালো খোজা

প্রধান সাদা খোজা

অটোমান সাম্রাজ্যে প্রধান সাদা খোজাকে বলা হত কাপি আগাসি। হেরেমে এবং দরবারের ভেতরে ৩০০-৯০০ সাদা খোজা কাজ করত। তারা সাধারণত প্রশাসন সংক্রান্ত বিষয়াদি, সংবাদ আদান প্রদান, মামলা মোকদ্দমার কাজ, সুলতানের কাছে প্রেরিত রাষ্ট্রীয় নথিপত্র দেখভালের কাজ করত৷ খোজাদের প্রশিক্ষণের জন্য বিশেষ স্কুলের প্রধান হিসেবেও প্রধান সাদা খোজা কাজ করতেন। এছাড়া প্রাসাদের ফটকের প্রধান, চিকিৎসা প্রধান এবং রাজকীয় অনুষ্ঠানের সমন্বয় সাধনেও সাদা খোজাদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়৷ সকল সাধারন সাদা খোজা প্রধান খোজার অধস্তন হিসেবে কাজ করত। প্রধান সাদা খোজা অনেকসময় সুলতানের সাথে একান্তে আলাপ আলোচনারও ক্ষমতা রাখতেন। ধীরে ধীরে সাদা খোজাদের প্রভাব বাড়তে থাকলে তা নজরে আসে সুলতান ৩য় মুরাদের। তিনি সাদা খোজাদের ক্ষমতা সম্পূর্ণরূপে হ্রাস করে কালো খোজাদের নিকট বিলিয়ে দেন।

অটোমান সাম্রাজ্যের শেষদিকে এসে কালো ও সাদা উভয় খোজাই প্রবল ক্ষমতাশালী হয়ে উঠে৷ রাজনৈতিকভাবে এসব খোজারা প্রভাব কায়েম করতে গিয়ে প্রায়শই সাম্রাজ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করত। শেষদিকে এদের প্রভাব ও ক্ষমতা উত্তরোত্তর বাড়তে থাকলে তার নাগাল টেনে ধরেন মুরাদ পরবর্তী সুলতানগণ।  আর এরই সাথে অটোমান সালতানাতে খোজাদের গৌরবময় অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটতে থাকে।