১৮ শতকের শুরুর সময়। পুরো ইউরোপ জুড়েই পরিবর্তনের হাওয়া বইছে। প্রাচীন গ্রামকেন্দ্রিক কৃষিব্যবস্থা ভেঙ্গে চুরে শহরভিত্তিক কলকারখানা গড়ে উঠছে। পুরো ইউরোপের মধ্যে উন্নয়নের দৌড়ে সবথেকে এগিয়ে আছে গ্রেট ব্রিটেন। আধুনিক শিল্পভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার জন্য আর্থ-সামাজিক এক পরিবর্তন হচ্ছে। ইউরোপকেন্দ্রিক এই পরিবর্তনের নাম হচ্ছে শিল্প বিপ্লব (Industrial Revolution)।
পুরো ইউরোপে ‘শিল্প বিপ্লব’ মূলত একদিনের কোন ঘটনা নয়, বরং গোটা মহাদেশেই ক্রমান্বয়ে শিল্পভিত্তিক একটি পরিবর্তন ঘটেছিল। ১৮ শতকের ঠিক মধ্যভাগে ইউরোপের বেড়ে চলা জনসংখ্যা এই পরিবর্তনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবকের ভূমিকা পালন করেছে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা থেকে দলে দলে ‘দক্ষ এবং কর্মঠ’ শ্রমিক শ্রেণী তৈরি হয়েছে। ঠিক একই সাথে উৎপাদন ক্ষেত্রে নতুন নতুন প্রযুক্তির আবির্ভাব এবং ব্যবহার এই উন্নয়নের পরিবর্তনকে আরও বেগবান করেছে। এ সময়ে বাড়তি জনসংখ্যার চাহিদা মেটানোর তাগিদে পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত হয়। উন্নয়ন বিপ্লবের এই দৌড়ে ব্রিটেন ঠিক দুটি কারণে ইউরোপের অধিকাংশ দেশ থেকে বেশ এগিয়ে ছিল।
১। ‘উৎপাদনমুখী এবং স্বনির্ভর’ কৃষি ব্যবস্থা
২। বিস্ময়কর এক ‘উদ্ভাবক’ শ্রেণী
১৮ শতক এবং তার পরবর্তী সময়ে এই দুই সুনির্দিষ্ট কারণে ইউরোপের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় ব্রিটেনে শিল্প বিপ্লবের সাফল্য এবং অগ্রগতি সবথেকে দ্রুত এবং কার্যকরী ছিল।
গ্রেট ব্রিটেন
ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের অঞ্চলগুলোতে সবথেকে প্রথমে ‘সুতা কাটার যন্ত্র’ আবিষ্কৃত হলে বস্ত্রশিল্পে এক অপার সম্ভাবনার ক্ষেত্র তৈরি হয়। পরবর্তীতে তাঁত বুনন-যন্ত্র আবিষ্কৃত হলে প্রচলিত বুনন পদ্ধতির পরিবর্তে এক যান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু হয় এবং ফলাফল হিসেবে বস্ত্র-শিল্পে এক পরিবর্তনের জোয়ার তৈরি হয়। বস্ত্র শিল্পের পাশাপাশি লৌহ শিল্পের ক্ষেত্রে এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন আসে। কয়লা থেকে ইঞ্জিন চালানোর কৌশল আবিষ্কৃত হলে পুরো ব্রিটেনের শিল্প-কলকারখানা চালানোর জন্য এক ‘অনন্ত জ্বালানী উৎস’ উন্মোচিত হয়। শিল্পক্ষেত্রে স্টিম ইঞ্জিনের আগমন ঘটলে ফার্নেস চুলা আরও দ্রুত এবং দক্ষভাবে জ্বালানোর একটি কার্যকরী পদ্ধতি পাওয়া যায়। কয়লাপ্রধান অঞ্চলগুলোতে দ্রুত থেকে দ্রুততম সময়ে আকরিক লোহা থেকে লৌহজাত পণ্য উৎপাদনের জন্য কারখানা গড়ে উঠতে শুরু করে। ব্রিটেনের চারিদিকে তখন শুধুই পরিবর্তনের জোয়ার, কারখানায় লোহার ঝনঝনানি, ব্রিটেনের আকাশে-বাতাসে তখন শুধুই কয়লাভিত্তিক ইঞ্জিনের কালো ধোঁয়া।
নতুন শিল্পাঞ্চলগুলোতে গ্রাম থেকে দল বেঁধে মানুষ কাজের খোঁজে আসতে শুরু করে। পরবর্তী কয়েক বছরে অনেক গ্রামের চেহারা আমূলে পাল্টে যায়, গ্রামাঞ্চল ক্রমশ শিল্পভিত্তিক শহরে পরিণত হতে শুরু করে। হাজার হাজার মানুষ তাদের আবাসন হিসেবে শহরভিত্তিক স্যাঁতস্যাঁতে বস্তি এলাকায় বসবাস শুরু করে। শ্রমিকেরা ব্যস্ত যান্ত্রিক জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, কাজের সময় হিসেবে তাদের তখন প্রায় ১৪ ঘণ্টা অমানুষিক পরিশ্রম করতে হত । কয়লাখনি এবং টেক্সাইল শিল্পে মহিলা শ্রমিকরাও পুরুষদের সমান তালে পরিশ্রম করতে শুরু করে, অথচ মজুরির বেলায় তারা পুরুষদের থেকে অনেক কম পেত। চারিদিকে সস্তায় শিশুশ্রমের বিষয়টিও ক্রমান্বয়ে বাড়তে শুরু করে। শ্রম সুলভে পাওয়ার কারণে শ্রমিকদের মধ্যে প্রতিনিয়ত কাজ হারানোর এবং না খেয়ে থাকার ভয় কাজ করত । শ্রমিক নির্যাতন, হতাশা, ন্যায্য পারিশ্রমিক না পাওয়ার মতো বিষয়গুলো থেকে ক্রমান্বয়ে শ্রমিক অসন্তোষ জন্ম নিতে শুরু করে। বিভিন্ন কারখানায় কমবেশি শ্রমিক বিদ্রোহের ঘটনা ঘটতে থাকে। শ্রমিক বিদ্রোহ থেকে কোন কারখানায় পণ্য উৎপাদন বন্ধ হলে অচিরেই শ্রমিক ছাঁটাই এবং চাকুরিচ্যুতির মাধ্যমে আবারো কারখানা চালু করা হতো। আধুনিক ইস্পাত শিল্প যোগাযোগ ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী এক পরিবর্তন আনে। নতুন নতুন রেল লাইন স্থাপনের মাধ্যমে জাতীয় রেল সংযোগ প্রথমে পুরো ব্রিটেনকে এবং পরবর্তীতে পুরো ইউরোপকে একীভূত করে তোলে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির মাধ্যমে আধুনিক পরিবহণ ব্যবস্থার বদৌলতে শিল্প-কলকারখানা এবং পণ্যের উৎপাদন আগুনের মতো পুরো ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে।
ফ্রান্স
ব্রিটেনের বাইরে ইউরোপের অন্যান্য দেশের মধ্যে শুধুমাত্র ফ্রান্সেই সমসাময়িক সময়ে ব্রিটেনের সমান তালে শিল্প বিপ্লব ঘটে। ১৮ শতকের প্রথম ভাগে ব্রিটেনের মতোই ফ্রান্সে সুতার উৎপাদন রাতারাতি প্রায় ৫ গুন বেড়ে যায়। ফ্রান্সের বস্ত্রশিল্পে এই সময়ে উৎপাদনের ক্ষেত্রে পরিমানের তুলনায় গুনগত মানের দিকে বেশি নজর দেওয়া শুরু হয়। অভিজাত শ্রেণীর জন্য হাতে বোনা সিল্ক এবং চামড়াজাত নানা পণ্যসামগ্রীর মতো বিভিন্ন জাঁকজমকপূর্ণ বস্ত্র উৎপাদন শুরু হয়। সনাতন পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে এসে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে পণ্য উৎপাদন ব্যবস্থায় এটাই মূলত ১ম পদক্ষেপ ছিল। যান্ত্রিক পণ্য উৎপাদন ব্যবস্থা মোটামুটিভাবে প্রতিষ্ঠিত হলে ১৮৩০ সালের দিকে লিয়ন্সের দক্ষ শ্রমিকেরা ‘নূন্যতম মজুরি’ প্রতিষ্ঠার দাবিতে সিল্ক-শিল্পে বেশ বড় ধরণের একটি বিদ্রোহ করে। ফ্রান্সে ব্রিটেনের মতো কয়লা এবং লোহার মজুরি না থাকায় এই সম্পর্কিত শিল্পগুলোতে বেশ দেরিতে বড় ধরণের কোন পরিবর্তন ঘটে। ১৯ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে ফ্লান্সের রেল ব্যবস্থাপনায় বেশ বড় ধরণের অগ্রগতি সাধিত হয়। কৃষিনির্ভর ফ্রান্স ধীরে ধীরে শিল্পনির্ভর ফ্লান্সে পরিবর্তিত হয়।
বেলজিয়াম এবং সুইজারল্যান্ড
ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শিল্প বিপ্লবের পটভূমি ভিন্ন ভিন্ন। বেলজিয়ামে সমৃদ্ধ আকরিক লোহা, কয়লা এবং বস্ত্র শিল্পে প্রথম শিল্প বিপ্লবের ছোঁয়া লাগে। বেলজিয়ামে ব্রিটেনের হাত ধরেই এই অগ্রগতি সাধিত হয়। সুইজারল্যান্ডের ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন আবার পুরোপুরি আলাদা। এখানে পর্যাপ্ত কাঁচামালের অভাব থাকার কারণে বিভিন্ন সিল্ক শিল্প, সুতি শিল্প এবং প্রকৌশল বিদ্যায় (যেমন- ঘড়ি তৈরি) প্রথমে অগ্রগতি সাধিত হয়। ইউরোপের অন্যান্য অংশ যেমন-স্পেন, গ্রিস এবং পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে বেশ পরের দিকেই শিল্পভিত্তিক পরিবর্তন আসে। কৃষিক্ষেত্রে উন্নতির মাধ্যমে পর্যাপ্ত রপ্তানির পথে হেঁটে এইসব দেশ ক্রমান্বয়ে শিল্পভিত্তিক ব্যবস্থাপনার দিকে অগ্রসর হয়।
জার্মানি
জার্মানিতে এই সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক সমস্যা থাকার কারণে এই অঞ্চলে শিল্পভিত্তিক অগ্রগতি বেশ পরের দিকেই দৃশ্যমান হয়। ১৮৩৪ সালের পরে জার্মানির খনি প্রধান অঞ্চলগুলোতে কলকারখানার বিস্তার ঘটতে থাকে। ঠিক এই সময়ে রেল ব্যবস্থাপনার সম্প্রসার ঘটার ফলে ষ্টীল উৎপাদন এবং যান্ত্রিক প্রকৌশল ব্যবস্থাপনায় বেশ বড় ধরণের একটি পরিবর্তন আসে। জার্মানিতে শিল্পভিত্তিক পরিবর্তন বেশ দেরিতে ঘটলেও পর্যাপ্ত পুঁজি এবং দক্ষ জনবলের কারণে ১৯ শতকের শেষের দিকে রসায়ন এবং বৈদ্যুতিক প্রযুক্তিগত পরিবর্তন হয়। এসময়ে ইউরোপের অন্যান্য সব দেশের সাথে তাল মিলিয়ে শিল্প নির্ভর জার্মানির উত্থান ঘটে।
শ্রমিকদের রাজনৈতিক মতাদর্শ
ইউরোপের বিভিন্ন অংশে শিল্পের বিস্তার ঘটার সাথে সাথে শ্রমিকদের মধ্যেও স্বার্থ এবং অধিকার সচেতনতামূলক পরিবর্তন দৃশ্যমান হয়। ১৮৬৩ সালে জার্মানিতে শ্রমিকদের সমন্বয়ে ১ম কোন রাজনৈতিক দলের উত্থান ঘটে। ১০৯০৬ সালে শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষণে ব্রিটেনে বিখ্যাত রাজনৈতিক সংগঠন ‘ব্রিটিশ লেবার পার্টি’র জন্ম হয়।
শ্রমিক স্বার্থ সংরক্ষণ
পরবর্তী সময়ে পুরো ইউরোপ জুড়েই বেশ কয়েকটি বড় ধরণের শ্রমিক দাঙ্গা সংগঠিত হয়। ফলশ্রুতিতে শিল্পক্ষেত্রে সরকারি আইন প্রণীত হলে মালিক পক্ষীয় হস্তক্ষেপ কমতে শুরু করে। শ্রমিক স্বার্থ সংরক্ষণে ইউরোপের দেশে দেশে শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে ২০ শতকের ১ম ভাগে উন্নততর বেতন সুবিধা এবং নিরাপদ কাজের পরিবেশের দাবিতে ইউরোপের বিভিন্ন অংশে শ্রমিক বিক্ষোভ ঘটে। উত্তাল আন্দোলনের মুখে বিভিন্ন দেশে প্রথমে ১২ ঘণ্টা এবং পরবর্তীতে ১০ ঘণ্টা কর্মদিবস চালু হয়।
আইন প্রণয়ন
১৮৪২ সালে ব্রিটেনে শিশু এবং নারীশ্রম বন্ধের জন্য আইন প্রণীত হলে কলকারখানার কঠোর পরিশ্রমের কাজগুলোতে শিশু এবং নারীদের নিয়োগ করা ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে। পরবর্তীতে ফ্লান্স, প্রুশিয়ার মতো দেশগুলোতে নারী এবং শিশুশ্রম বন্ধের জন্য আইন প্রণীত হয়। ১৮৮০ সালে জার্মানিতে শ্রমিকদের অসুস্থতা, দুর্ঘটনা এবং বয়সকালীন নিরাপত্তার জন্য ভাতা ব্যবস্থা চালু হলে পুরো ইউরোপে শ্রমিক কল্যাণে ‘যুগান্তকারী এবং অভূতপূর্ব’ এক পরিবর্তন ঘটে।
শিল্পায়নের কারণে পুরো ইউরোপেই একদিকে যেমন গ্রাম উজাড় করে কলকারখানা স্থাপনের মাধ্যমে শহরায়ন হয়েছে , ঠিক তেমনি শহরভিত্তিক আবাসনের নামে বস্তির সংখ্যা বেড়েছে। শিল্প বিপ্লব একদিকে যেমন পণ্য, আধুনিক যোগাযোগ এবং কারখানা নির্ভর আধুনিক ইউরোপের জন্ম দিয়েছে, ঠিক তেমনি শান্ত, নির্জন এবং কৃষিনির্ভর ইউরোপকে কেড়ে নিয়েছে।
লিখেছেনঃ Sajal Paik – সূত্রঃ রোয়ার বাংলা…