আমার দেখা প্রাগ: ঐতিহ্য, রুচিশীলতা ও আধুনিকতার বর্ণিল মিশেল যে শহর

2295
0

ছবির মত সুন্দর একটা শহর। শহরের বুক চিরে বয়ে গেছে ভলটাভা নদী। বেশ প্রশস্ত ও খরস্রোতা। জলের ওপর কোনো খড়কুটো নেই। দেখে মনে হয়, নদীর যত্ন নেয়া হয় ভালোভাবেই। ভলটাভার ওপর দেড়শ’ বছরের পুরনো সেতু। নাম চার্লস ব্রিজ। সেই ব্রিজকে নিয়েই সাজানো প্রাগের এই গল্প।

প্রাগ হলো চেকোস্লোভাকিয়ার রাজধানী। সুইডেনের স্টকহোমে থাকি, সেখান থেকে খুব একটা দূরে নয়। তাও যাব যাব করে ঠিক যাওয়া হয়ে ওঠেনি। অথচ এদেশ-ওদেশ ঠিকই ঘোরা হচ্ছিল। একদিন ইন্টারনেটে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতেই চার্লস ব্রিজের রঙিন ছবিতে চোখ আটকে গেলো। মনে হল, আর দেরি নয়, এবার প্রাগ, এবার চার্লস ব্রিজ!

কোনো দেশ বা শহর যদি আপনি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখতে চান, তাহলে দু’পায়ের উপরই ভরসা করতে হয়। গাড়ি হাঁকিয়ে দেখার মধ্যে মজা নেই। তাই ঠিক করলাম, প্রাগ পায়ে হেঁটে চষে বেড়াব। তবে এক স্থান হতে অন্য স্থানে ট্রাম, বাস, লোকাল ট্রেন ব্যবহার করা যেতে পারে।

দিনক্ষণ ঠিক করে ইন্টারনেট ঘেটে একটি চার-তারকা হোটেল বুক দেওয়া হলো। হোটেলের কাছেই স্টেশন, নাম কোবিলিসি। কোবিলিসি প্রাগের এক বিখ্যাত জায়গা। সাস আর চেক এয়ারে টিকেট কেটে ব্যাগ গোছানো শুরু হলো।

দু’টি দেশ মিলে একটি দেশ। চেক ও স্লোভাকিয়া- দুই মিলে চেকোস্লাভাকিয়া। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরপরই ১৯১৮ সালের ২৮ অক্টোবর প্রাগে স্বাধীনতা সনদ সাক্ষরিত হয়। চেক ও স্লোভাকিয়ার আর্থিক ভারসাম্য যদিও সমান্তরাল ছিল না, তবু শুধু স্বাধীনতা প্রশ্নে দেশ দু’টি একত্রিত হয় ও স্বাধীনতা লাভ করে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের জার্মান বাহিনী দেশটি দখল করে নেয়। স্বাধীনতা হারায় চেকোস্লোভাকিয়া। এরপর ১৯৪৮ সালে শুরু হয় কমিউনিস্ট শাসন। ১৯৬৮ সালে সোভিয়েত আগ্রাসনে শাসিত হয় দেশটি। ১৯৮৯ সালে শুরু হয় কমিউনিস্ট বিরোধী আন্দোলন। ১৯৯২ সালে দু’টি দেশ চেক ও স্লোভাকিয়া আলাদা হয়ে স্বাধীনতা লাভ করে।

বিংশ শতকের মাঝামাঝিতে প্রাগ; Image Source: Cash Advance Online

প্রাগে যাওয়ার দিনক্ষণ কাছে এগিয়ে আসা মাত্রই বুকিং দেয়া হোটেল থেকে হিসাব হালনাগাদ করার বার্তা এলো। ভিসা কার্ড দিয়ে এর আগেও বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন হোটেল বুক দিয়েছি। তারপর বিল পরিশোধ করেছি হোটেলে উঠে। কিন্তু এধরনের বার্তা এর আগে পাইনি।

যাই হোক, নির্ধারিত দিনে প্রাগে এলাম। সাজানো গোছানো দৃষ্টিনন্দন বিমান বন্দর। আমাদের সঙ্গে শুধু হ্যান্ড-লাগেজ। কাজেই বেল্ট থেকে কোন লাগেজ কালেক্ট করতে হলো না। দুই নম্বর টার্মিনাল হতে বিমান বন্দরের বাস যাবে সেন্ট্রাল প্রাগে। আমাদের বহনকারী বিমানটি ল্যান্ড করেছে পাঁচ নম্বর টার্মিনালে। পাঁচ নম্বর দিয়ে বের হয়েই দু’নম্বর টার্মিনাল।

পায়ে হাঁটা এক মিনিটের পথ। বাস এসে দাঁড়াতেই অপেক্ষমান যাত্রীরা এক এক করে উঠে এলেন। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস- জনপ্রতি ষাট কুনা টিকেট। টাকার হিসেবে মাত্র তিনশ’ টাকা। রৌদ্রোজ্জ্বল দিন। বিরতিহীন বাস ছুটে চলেছে সেন্ট্রাল প্রাগের দিকে। প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট ছোটার পর বাস এসে থামলো সেন্ট্রাল স্টেশনের মাথায়। লিফ্‌ট দিয়ে নিচে নেমেই সেন্ট্রাল স্টেশন।

প্রাগের সেন্ট্রাল মেট্রো স্টেশন; Image Source: Digital Gude

ঘড়িতে দেখলাম হাতে সময় আছে, তাই কিছু খেয়ে নেওয়া যাক। বাঁ দিকে তাকিয়েই দেখলাম ম্যাক্স বার্গার। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন আলোকোজ্জ্বল সেন্ট্রাল স্টেশন। এখান থেকেই তিনটি রেড, গ্রীন আর ইয়েলো লাইনে বিভিন্ন জায়গায় ট্রেন, পাতাল ট্রেন যায়।

খাবার পর্ব শেষ করে রেল কাউন্টারে এসে দাঁড়ালাম। আমাদের গন্তব্য কোবিলিশি স্টেশন। সেন্ট্রাল থেকে রেড লাইনে মাত্র চার স্টেশন। কাউন্টারের পাশ দিয়েই কোবিলিশি যাবার প্ল্যাটফর্ম। মাত্র আট মিনিটেই কোবিলিশি এসে পৌঁছুলাম। প্ল্যাটফর্মে নেমে ভাবছিলাম কোন দিক দিয়ে স্টেশন হতে বের হব?

বের হবার রাস্তা দু’টি- ডান ও বাঁ দিক। হোটেল থেকে বলেছিল কোবিলিশি থেকে হোটেলের দূরত্ব মাত্র সাত মিনিটের হাঁটা পথ। তাকিয়ে দেখলাম, প্ল্যাটফর্মে একটি ছেলে মোবাইলে কথা বলছে। সে হয়তো ট্রেনের অপেক্ষায়। তার কাছে গিয়ে হোটেলের পথ জানতে চাইলাম।

ছেলেটি মোবাইলে কথা শেষ করেই ইন্টারনেট ঘাটতে লাগলো। একবর্ণ ইংরেজি না জানলেও তার ভাষায় ও হাতের ইশারায় জানাল, “অসুবিধে নেই, একটু অপেক্ষা কর”। এর মধ্যে পরপর তার দু’টি ট্রেন চলে গেছে। সে আমাদের নিয়েই ব্যস্ত। অবশেষে আমাদের সঙ্গে নিয়ে ডানদিকের নির্গমন পথ দিয়ে উপরে নিয়ে এসে হোটেলে যাবার রাস্তাটি দেখিয়ে দিলো।

সামনে এগিয়ে গেলাম। হোটেল পাচ্ছি না। আর একটু সামনে এগিয়ে দেখলাম একটি রেস্টুরেন্ট। রেস্টুরেন্টের সামনে একটি ছেলে দাঁড়িয়ে, পায়ে ব্যান্ডেজ। কাছে গিয়ে হোটেলটির অবস্থান জানতে চাইলাম। ছেলেটি ভালো ইংরেজি বলে, জানালো হোটেলটি সামনে রাস্তার মোড়েই। তবে কিছুটা ঘুরে যেতে হবে। রাস্তায় কাজ হচ্ছে বলে সোজা রাস্তাটি বন্ধ। আবার বললো, “তোমরা শহরে নতুন, তাই ঘোরা পথটি হয়তো চিনতে পারবে না। ট্যাক্সি কল করেছি হাসপাতালে যাব পা দেখাতে, আমি তোমাদের নামিয়ে দিয়ে হাসপাতালে যেতে পারি।”

সত্যই ছেলেটি আমাদের হোটেলের সামনে নামিয়ে দিয়ে হাসপাতালে গেল। হোটেলে উঠে ফ্রেশ হয়ে নির্বিঘ্নে রাত কাটিয়ে দিলাম।

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে কফি বা চায়ের আশায় একতলা রিসেপশনে নেমে এলাম।

রিসেপশনের পাশেই মাঝারি সাইজের একটি হলে চেয়ার টেবিল পাতা। পরিপাটি করে নাস্তা সাজানো। পাশেই জুস, চা ও কফি কেবিন। কলা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের রুটি, মাখন, মধু, চিজ ইয়োগোট, সালাদ, ডিম আরো অনেক কিছু। তবে চার তারকা হোটেলের অনুপাতে একটু কম মনে হলেও আন্তরিকতার অভাব নেই। প্রতিটি টেবিলের উপর দৈনন্দিন ডলার, ইউরো, পাউন্ডের বিনিময় হারের তালিকা। নাস্তা পর্বের পর প্রাগ দেখার পালা।

ঐতিহ্যবাহী চেক খাবার; Image Source: TripAdvisor

হোটেল হতে বের হবার আগে রিসেপশনে জানতে চাইলাম কোবিলিশি স্টেশন হতে হোটেলের দূরত্ব হাঁটা পথে সাত মিনিট হলে গতকাল আমাদের এত সময় লাগল কেন? রিসেপশনিস্ট শুনে একটু অবাক হয়ে বললেন, “নিশ্চয়ই তোমরা স্টেশনের ডানদিক দিয়ে বের হয়েছ? বাঁ দিক দিয়ে কাছে।”

প্রাগের পুরানো শহরটি ঐতিহাসিক নিদর্শনে পূর্ণ ও পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয়। রিসেপশান হতে পুরানো শহরে যাবার ম্যাপ সংগ্রহ করে ট্রাম স্টেশনে এসে দাঁড়ালাম। ট্রাম ছুটে চলল পুরানো শহরে। যে শহরে আছে চার্লস ব্রিজ, ক্লক টাওয়ার, আলবার্ট আইনস্টাইনের আবাসস্থল।

হোটেল হতে বের হয়ে রাস্তার মোড় হতে ট্রামে করে স্টারমোয়েস্কা স্টেশন। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে ওল্ড টাউন বা পুরনো শহরে। ওল্ড টাউনে সিটি হল। ১৩৩৮ সাল হতে সিটি হল থেকেই প্রাগ তথা দেশের শাসন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা হতো। রাজা, রাজপরিষদ সবাই সিটি হলে বসে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। কখনো কখনো বিদ্রোহীদের বন্দীশালা হিসেবে সিটি হলকে ব্যবহার করা হতো।

সিটি হলের সাথেই লাগোয়া বিখ্যাত অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ক্লক বা জ্যোতিষ ঘড়ি। ঘড়িটি নির্মিত হয় ১৪১০ সালে। তবে বিশেষ বিশেষ সময়ে এটি মেরামত করা হয়েছে। ঘড়িটি জোডিয়াক ক্যালেন্ডার ও ঘড়ি দুটিই প্রদর্শন করে। প্রাগের এই অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ঘড়ি পৃথিবীর একমাত্র ঘড়ি, যা আজো সময়, দিন, সপ্তাহ ও বছর প্রদর্শন করে আসছে।

প্রাগের বিখ্যাত অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ঘড়ি; Image Source: Documentary Tube

আমরা যখন ঘড়ির কাছে এসে দাঁড়ালাম, তখন বেলা বারোটা বাজার কয়েক মিনিট বাকি। হাজার হাজার উৎসুক ভ্রমণকারী ঘড়ির সামনে দাঁড়িয়ে। আমরাও দাঁড়িয়ে গেলাম। ঠিক বারোটা বাজার সঙ্গে সঙ্গেই ঘড়ির পার্ট খুলে গেলো। টুং টুং শব্দ করতে করতে পাখি, কঙ্কাল, বিভিন্ন পশুপাখি ও নারী পুরুষের মূর্তি চক্রাকারে গান গাইতে লাগলো। সে এক স্মরণীয় মুহূর্ত।

ওল্ড টাউনের রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে একটি বড় দরজার দেয়ালে চোখ আটকে গেল। দেয়ালে বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের মুখোচ্ছবি ও কিছু উক্তি খোদাই করা। নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনেস্টাইনের সঙ্গে এখানে দেখা হতো বিখ্যাত লেখক ম্যাক ব্রেড ও ফ্রানস্‌ৎ কাফকার।

১৯১১-১৯১২ সালে আইনস্টাইন প্রাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন। ঠিক এই সময় লিখেছিলেন তার বিখ্যাত গবেষণাপত্র, দ্য থিওরি অফ রিলেটিভিটি। দরজা পেরিয়ে কয়েকটি পুরানো বাড়ি, এখানেই এই পুরনো শহরেই থাকতেন আইস্টাইন। যদিও তার বাসস্থানটি সংরক্ষণ করা হয়নি।

প্রাগের পাট চুকিয়ে আইনস্টাইন চলে গিয়েছিলেন সুইজারল্যান্ডের জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে। দেশটির রাজধানী বার্নে গড়ে তোলা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন আইনস্টাইন মিউজিয়াম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠিত হলে আইনস্টাইনকে প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, কিন্তু তিনি সে আমন্ত্রণ গ্রহণ করেননি।

আইনস্টাইনের স্মৃতিবিজড়িত প্রাগ; Image Source: Mark Baker Blog

পুরানো শহরের ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো দেখতে দেখতে এতই বিভোর হয়ে গিয়েছিলাম যে, লাঞ্চের কথা মনেই আসেনি। একটি হোটেলে পিজ্জা দিয়ে লাঞ্চ সেরে আবার বেরিয়ে পড়লাম। এবার গন্তব্য চার্লস ব্রিজ, আইনস্টাইন আবাসস্থলের কাছেই। আকাশে মেঘ ডাকতে শুরু করেছে।

মেঘের গর্জনের পরপরই বিদ্যুত চমকের সঙ্গে সঙ্গে নেমে এলো বৃষ্টি। বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করতে হল। শেষ বিকেলে বৃষ্টি কমে গিয়ে আঁধার নেমে এলো। ততক্ষণে চার্লস ব্রিজের আকর্ষণ কমে এসেছে। স্বল্প সময়ের মনিহারী দোকানগুলো গুটিয়ে ফেলা হয়েছে। তবুও পর্যটকদের ভিড়।

প্রাগের ভলটাভা নদীর উপর সতেরটি সেতুর মধ্যে চার্লস ব্রিজ অন্যতম। চেক রাজা চতুর্থ চার্লসের নামানুসারে ১৩৫৭ সালে এই সেতু নির্মিত হয়। ১৫টি পিলারের উপর স্থাপিত ৬২১ মিটার লম্বা ও ১০ মিটার প্রশস্ত সেতুটি জলের কিনারা হতে ১৩ মিটার উঁচুতে।

এগারোশ’ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে ভলটাভা নদীর উপর সেতু নির্মাণের প্রচেষ্টা চলছিল। প্রথমে কাঠের ফ্রেমে কাঠামো তৈরি করা হলেও ১১৫৭ সালে তা ধ্বংস হয়ে যায়। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর অবশেষে নির্মিত হয় সেতুটি।

বালির বস্তাকে পাথরের মত শক্ত করে সেতু নির্মাণে ব্যবহার করা হয়। শক্ত করার কাজে ডিমসহ আরো কিছু উপাদান মেশানো হতো। একসময় দেখা গেলো শহরে আর ডিম পাওয়া যাচ্ছে না। তখন গ্রামের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে ডিম আনা শুরু হলো। অনেক সময় দেখা গেল, দূর-দূরান্ত থেকে ডিম আসতে আসতে পথিমধ্যে ভেঙে নষ্ট হয়ে যায়। তখন বয়েল ডিম আনার ব্যবস্থা হলো।

চার্লস ব্রিজে সূর্যাস্ত; Image Source: PragueGO

ইতিহাসবিদরা ডিমের বিষয়টির সত্যতা খুঁজে পেয়েছেন কিনা জানা যায় না, তবে সেকালে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে কোনো স্থাপনা নির্মাণে ডিমের ব্যবহার ছিল। উনিশ শতকে নির্মিত মুর্শিদাবাদের হাজারদুয়ারী প্রাসাদ নির্মাণেও ডিমের ব্যবহার করা হয়েছে।

সেকালে চার্লস ব্রিজকে অপরাধী দমনে ব্যবহার করা হতো। রাজতন্ত্রবিরোধী, সামাজিক অপরাধী, চোর ডাকাত ধোঁকাবাজদের ব্রিজের ওপর থেকে নদীতে নিক্ষেপ করা হতো। রানির সঙ্গে মতবিরোধে বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব জন অব নেপোমুখকে ১৩৯৩ সালে ব্রিজের ওপর হতে ভলটাভা নদীতে নিক্ষেপ করা হয়।

ব্রিজের উপর জন অব নেপোমুখের স্ট্যাচু এখনো বিদ্যমান। চার্লস ব্রিজের শেষে মাথা বাঁকানো শ্মশ্রুমণ্ডিত এক বৃদ্ধের মূর্তি। বৃদ্ধ ব্যক্তিটি দিন রাত জলের দিকে তাকিয়ে জলের উচ্চতা পরিমাপ করেন। ব্রিজ পার হয়ে আমরা এপারে চলে এলাম। বিকেল হয়ে গেছে। হোটেলে ফিরে বিশ্রাম প্রয়োজন।

জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, কাছেই মেট্রো স্টেশন, তিন স্টেশন পরই সেন্ট্রাল, তারপর সেন্ট্রাল হতে কোবিলিশি। মেট্রো স্টেশনে যেত যেতে ফ্রানস্‌ৎ কাফকা মিউজিয়ামের পাশে এসে দাঁড়ালাম। বিখ্যাত লেখক ফ্রানস্‌ৎ কাফকার জন্ম পুরানো শহরে। দুটো ধারায় জীবনকে প্রবাহিত করতেন কাফকা, দিনের বেলায় নম্র ভদ্র ইন্স্যুরেন্সের অফিস সহকারী আর রাতের বেলায় কঠোর নিষ্ঠাবান লেখক।

কাফকা যাদুঘর প্রাঙ্গন; Image Source: Prague Here

পথে দেখি এক মেয়ে ভলটাভা নদীর উপর বোট ভ্রমণের টিকেট বিক্রি করছে। ঠিক হল পরদিন আমরা এখানে আবার আসবো প্রাগ আন্ডার দ্য ব্রিজ ভ্রমণে। মেয়েটি জানাল, একঘণ্টা পরপর বোট যায় ভলটাভার ওপর চার্লস ব্রিজসহ আরো ষোলটি ব্রিজের নিচ দিয়ে।

ঠিক হল পরদিন সকালে নাস্তা সেরেই নয়টার মধ্যে বেরিয়ে পড়ব। সকাল আটটায় ব্রেকফাস্ট রমরমে পর্যটকদের ভিড়। অধিকাংশ ইউরোপীয়। একটি পরিবার মনে হয় মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশ থেকে এসেছে। পরিবারের মেয়েরা সবাই রঙ-বেরঙের জামা কাপড় পরা।

হোটেল হতে বের হয়ে রাস্তার মোড়ে বেশ বড় একটি পার্ক। সবুজের সমারোহ। পার্কে লোকজন বেশী নেই দু-তিনজন বৃদ্ধা কুকুর নিয়ে সময় কাটাচ্ছেন। কুকুর পোষা চেকবাসীদের ঐতিহ্য। বলা হয় ”Russians love children and Czechs their dogs”.

তবে চেকরা যে নিজ সন্তানদের ভালোবাসে না, এমনটাও নয় অবশ্য। তবে পোষা কুকুরের প্রতি ভালোবাসাটা সন্তানের চেয়ে কোনো অংশে কমও নয়। চেকরাই ইউরোপে কুকুর পোষায় প্রথম স্থানটি দখল করে আছে। প্রায় প্রতিটি পরিবারে সার্ভেন্ট কোর্য়াটারের মতো বড় বড় বিছানা, থালা-বাসন, তোয়ালে ইত্যাদি সজ্জিত কুকুর কোর্য়াটার আছে। চেকরা কুকুর সঙ্গে নিয়েই হোটেল-রেস্তোরাঁয় খেতে যেত। সেখানেও কুকুরের জন্য আলাদা কাপ-প্লেট ও আলাদা খেদমতদার ছিল।

চেকদের কুকুরপ্রীতিকে ঘিরে প্রাগের পথেঘাটে ছড়িয়ে আছে নানা কিংবদন্তি; Image Source: Magic Bohemia

অতঃপর ট্রেনে সেন্ট্রালে এসে দাঁড়ালাম। অপ্রাপ্তবয়স্ক ও সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য ট্রেন টিকেটের মূল্য অর্ধেক। আমাদের গন্তব্য গ্রিন লাইনে মালোস্ট্রান্সকা স্টেশন। স্টেশন হতে পায়ে হাঁটা পথ চার্লস ব্রিজ। সেন্ট্রাল স্টেশনে এসে কোনো দিকে গ্রিন লাইন খুঁজে পাচ্ছিলাম না।

প্ল্যাটফর্মে এক ভদ্রমহিলা ট্রেনের অপেক্ষায়। তাকে প্রশ্ন করায় তিনি আমাদের নিয়ে এলিভেটরে করে উপরে নিয়ে এসে ট্রেনে বসিয়ে হাত নেড়ে বিদায় নিলেন। প্রাগে যেখানে যাকেই জিজ্ঞেস করেছি, সবাই নিজের কাজ ফেলে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। এমন সাধারণত হয় না।

মালোস্ট্রান্সকা স্টেশনে নেমে গতকালের মেয়েটির কাছে টিকিট কেটে বোটে উঠে বসলাম। ছোট বোট। আমাদের মত আরো অনেকেই বসে। আমরা বসতেই বোট ছেড়ে দিল। রৌদ্রোজ্জ্বল দিন। দিনের তাপমাত্রা বাড়ছে। আকাশে সাদা সাদা পেঁজা তুলার মতো মেঘ। এই মেঘে বৃষ্টি নেই। মৃদুমন্দ হাওয়া।

আমাদের বোট ভলটাভার স্বচ্ছ জলের ওপর হেলেদুলে যাত্রা করল। একটি মেয়ে এসে জানতে চাইল, আমরা কোনো সফ্‌ট বা হার্ড ড্রিংস চাই কিনা। কফি চাইলাম। বোটের মাইক্রোফোনে যাত্রার শুভকামনা করে নদীর দুপাশের স্থাপনা ও  ব্রিজগুলোর বর্ণনা ভেসে এলো।

প্রায় দু’ঘন্টা নদীপথে ভ্রমণশেষে সেন্ট্রাল স্টেশনে ফিরে এসে মনে হলো প্রাগ দেখা প্রায় শেষ। কয়েকটি রাজপ্রাসাদ ও গির্জা ভ্রমণকারীদের আকর্ষণ করে। তবে সেগুলো আর দেখতে ইচ্ছে হলো না। তুরস্ক আর সাইপ্রাসে এত গির্জা দেখেছি যে, গির্জা দেখার আকর্ষণই হারিয়ে ফেলেছি।

হাতে আরো একটি পুরো দিন। কী করা যায়? ভাবতে ভাবতে ভিয়েনার কথা মনে হলো। পুরো দিনটি ভিয়েনায় কাটানো যায়। প্রাগ থেকে মাত্র চার ঘন্টার ট্রেন। ভিয়েনাও দেখা হবে, ট্রেন ভ্রমণও উপভোগ করা যাবে। দ্বিধা না করে ভিয়েনার টিকেট কেটে নিলাম। পরদিন সকাল আটটায় ভিয়েনার ট্রেন।

প্রাগ থেকে ভিয়েনা, বার্লিন, বুদাপেস্ট, হামবুর্গ যাবার সরাসরি ট্রেন আছে। খুব যে দূরে তা নয়। দিনে যেয়ে দিনেই ফিরে আসা যায়। এক দেশ থেকে আর এক দেশে কোনো চেকিং নেই, ঝামেলাও নেই।

সদা প্রাণবন্ত ভিয়েনার পথঘাট; Image Source: City Like You

পরদিন ঠিক আটটায় ভিয়েনাগামী ট্রেন ছাড়লো। দ্রুতগামী ট্রেন- মাত্র তিনটি বিরতি। সময় পৌনে চার থেকে চার ঘন্টা। পথে ব্রেকলভ স্টেশনে ট্রেন বিরতি নেয় একটু বেশি। লাইন পাল্টাতে হয়।

ট্রেন চলেছে ঝড়ের গতিতে। কোনো শব্দ নেই, শুধু বিরতিহীন স্টেশনগুলো হুস করে বেরিয়ে যাওয়া ছাড়া। কোন পানওয়ালা চাওয়ালা ফেরিওয়ালা নেই। যাত্রীরা ল্যাপটপ, স্মার্টফোনে ব্যস্ত। কারো কারো হাতে ম্যাগাজিন দেখা গেল।

বেলা পৌনে বারোটায় আমরা অষ্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় এসে নামলাম। প্রাণোচ্ছল শহর হিসেবে ভিয়েনা পৃথিবীর মধ্যে প্রথম স্থানটি দখল করে নিয়েছে। তবে আমার দেখা শহরগুলোর মধ্যে সিডনি, মেলর্বোন, আমস্টারডাম, জুরিখ, জেনেভা, ইস্তানবুল, আনতলিয়া, এথেন্স, ক্যাসাব্ল্যাংকা, মারাকেশ যথেষ্ট প্রানবন্ত শহর।

ভিয়েনা স্টেশনটি অন্যান্য ইউরোপীয় স্টেশনের মত। ছিমছাম পরিষ্কার। লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে। স্টেশনের ভেতরেই ফুডকোর্ট। বিভিন্ন দেশীয় খাবারের রেস্টুরেন্ট। আমরা এক ভারতীয় রেস্টুরেন্টে টেবিল নিয়ে বসলাম। পোলাও, চিকেন-কারি, তন্দুরী, ভাজি ইত্যাদি।

প্রাগ ফিরে যাবার ট্রেন বিকেল পাঁচটায়। লাঞ্চ সারতে সারতে বেলা একটা বেজে গেল। আমাদের হাতে সময় মাত্র চার ঘন্টা। স্টেশন থেকে বের হয়ে চার ঘন্টায় ভিয়েনা শহর যতটুকু সম্ভব দেখে অতৃপ্ত মন নিয়ে আবার স্টেশনে ফিরে এলাম। ভিয়েনার রাস্তাঘাট অন্য ইউরোপীয় দেশগুলোর মতোই, তবে বিখ্যাত কিছু স্থাপনা ভিয়েনা ছাড়া আর কোথাও নেই।

সময় ও সুযোগ মতো ভিয়েনায় আবার আসতে হবে। চার ঘন্টা ভিয়েনা দেখার জন্য কিছুই নয়। রাত সাড়ে নয়টায় ফিরে এলাম প্রাগে, আরো তিরিশ মিনিট পর হোটেলে। পরদিন সকাল সাড়ে এগারোটায় স্টকহোমের ফ্লাইট। ফেরার কথা আর কী বলব। পরের কোনো ভ্রমণের কথাই নাহয় বলব। তবে অন্য কোনোবার।

লেখাঃ Liakat Hossain | সূত্রঃ রোয়ার বাংলা