১৯৮২ সালের “শিন্ডলার’স আর্ক” নামে উপন্যাস এবং ১৯৯৩ সালের স্টিভেন স্পিলবার্গের “শিন্ডলার’স লিস্ট” নামে মুভিটির প্রকাশের মাধ্যমে অস্কার শিন্ডলার সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য বিশ্ববাসীর সামনে আসে।অথচ এই অস্কার শিন্ডলারের জীবনাবসান হয়েছিল ১৯৭৪ সালেই।হিটলার বাহিনীর পৈশাচিক ইহুদি নিধনের হাত থেকে প্রায় ১২০০ ইহুদিদের রক্ষা করার গল্প অস্কার শিন্ডলারকে মহান করে তুলেছে।আজকের আর্টিকেলে সেই অস্কার শিন্ডলারকে নিয়েই কথা বলব।
কে ছিলেন এই অস্কার শিন্ডলার?
অস্কার শিন্ডলার ১৯০৮ সালে এক সম্ভ্রান্ত জার্মান ক্যাথলিক পরিবারে জন্ম নেয়।তার পিতা ছিলেন কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবসায়ী।স্কুল পাশ করার পর তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ শিক্ষা না নিয়ে প্রকৌশল ও গাড়ি চালানোর উপর প্রশিক্ষণ নেন এবং বাবার কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবসায় জড়িত হন।এরপরে তিনি জার্মান গোয়েন্দা সংস্থা এবং নাজি পার্টিতেও কাজ করেন।ব্যক্তিগত জীবনে সুবিধাবাদী ব্যবসায়ী,মদখোর ও নারীনেশায় আসক্ত একজন দূর্নীতিবাজ অস্কার শিন্ডলার যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নায়ক হয়ে যাবেন তা ছিল ভাবনার বাইরে।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে অস্কার নতুন করে ব্যবসা শুরু করতে একটি কারখানা কেনেন যেখানে ১২০০ এর মত ইহুদী কাজ করত।আর এটিই এই ১২০০ ইহুদিদেরকে হিটলারের নাজি পার্টির হত্যাযজ্ঞ থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল।
শিন্ডলারের প্রাথমিক জীবন
অস্কার শিন্ডলার তৎকালীন অস্ট্রিয়ায় জন্ম নিয়েছিলেন।তারা ছিলেন দুই ভাইবোন। তার শৈশব কেটেছিল এক ইহুদী পাদ্রীর ছেলেমেয়েদের সাথে। অস্কার শিন্ডলার ১৯২৪ সালে স্কুল ছেড়ে দিয়ে বেশ কয়েকটি চাকরি বদল করেছিলেন।যেমন, বাবার ব্যবসায় যোগদান,চেকোস্লোভাকিয়ায় সেনাবাহিনীতে চাকরি, ড্রাইভিং স্কুল চালানো, পোল্ট্রি ফার্ম ইত্যাদি।এসব কাজের মাঝে সঙ্গী ছিল মদ ও নারী নিয়ে ভোগবিলাস করা।অবশ্য এরই মাঝে ১৯২৮ সালে তিনি এমিলিকে বিয়ে করেছিলেন যিনি তার জীবনের কঠিন সময় থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সঙ্গ দিয়ে গেছেন।
গুপ্তচর থেকে কালোবাজারী উদ্যোক্তা
১৯৩০ এর দশকে, অ্যাডলফ হিটলার এবং জার্মান নাৎসি পার্টির উত্থানের সাথে ইউরোপের রাজনৈতিক দৃশ্যপট নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়।১৯৩৫ সালে শিন্ডলার নাৎসি-পন্থী সুদেটেন জার্মান পার্টিতে যোগ দেন এবং পরের বছর জার্মান সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আবওয়ের-এর জন্য গোপন তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু করেন।১৯৩৮ সালে চেকোস্লোভাকিয়া কর্তৃপক্ষ তাকে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে গ্রেফতার করে এবং মৃত্যুদণ্ড দেয়। মিউনিখ চুক্তির অংশ হিসেবে সেই বছরের শেষের দিকে জার্মানি সুদেটেনল্যান্ডকে সংযুক্ত করার পরে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল।আর ” জার্মান রীখ” তাকে ক্ষমা করে দেন কিন্তু অস্কার শিন্ডলার এই দ্বিতীয় সুযোগের সদ্ব্যবহার করে।
সেসময় পোল্যান্ডে জার্মান আক্রমণ ও দখলের সময়, শিন্ডলার ক্রাকোতে যান দলীয় ও ব্যবসায়ীক কাজে। জার্মান যোগাযোগের নেটওয়ার্কের জন্য ধন্যবাদ যে তিনি উদার ঘুষের মাধ্যমে ব্যবস্থা করেছিলেন, তিনি পূর্বে ইহুদিদের মালিকানাধীন এনামেলওয়্যার কারখানার ইজারা সুরক্ষিত করেছিলেন। তিনি ডয়েচে ইমেলওয়ারেন-ফ্যাব্রিক অস্কার শিন্ডলার (এমালিয়া নামে পরিচিত) সুবিধাটির নাম পরিবর্তন করেন এবং অল্প কর্মী নিয়ে উৎপাদন শুরু করেন।
১৯৩৯ সালে শিন্ডলার নাৎসি পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন।একই বছর সেপ্টেম্বরে জার্মানির পোল্যান্ড আক্রমণের মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। আর যুদ্ধ থেকে লাভের আশায় শিন্ডলার তার স্ত্রীকে রেখে ক্রাকোতে যান। ব্যবসার সুযোগ খুঁজতে তিনি দ্রুত কালোবাজারীতে জড়িয়ে পড়েন। অক্টোবরের মধ্যে, শিন্ডলার তার মনোমুগ্ধকর ব্যবহার ও উচ্চ-পদস্থ জার্মান অফিসারদের ঘুষ দিয়ে কৃতজ্ঞতার উপহারস্বরূপ একটি এনামেলওয়্যার কারখানার মালিক হন।
এ কারখানাটি ছিল ইহুদী মালিকানাধীন পরিত্যাক্ত একটি কারখানা যেখানে শিন্ডলার জার্মান সামরিক বাহিনীর জন্য পণ্য উৎপাদনের পরিকল্পনা করেন।
এনামেলওয়্যার কারখানা
নাৎসি পার্টির সদস্য হওয়ার সুবাদে শিন্ডলার ইহুদি শরণার্থী শিবিরে যেতেন।তখন তার সাথে ইজহাক স্টার্ন নামে একজন ইহুদি হিসাবরক্ষকের সাক্ষাত হয়, যিনি শিন্ডলারকে এই এনামেলওয়্যার কারখানা কিনতে পরামর্শ দেন।তারই পরামর্শে ইহুদিদের শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দেন শিন্ডলার কারণ ইহুদীদের তুলনামূলক কম পারিশ্রমিকে নিয়োগ দেওয়া যেত।
পোল্যান্ডে গিয়ে অস্কার শিন্ডলার তার নতুন এনামেলওয়্যার কারখানায় অল্প কর্মী নিয়ে উৎপাদন শুরু করেন।তিন মাস পরে তার কারখানায় কয়েকশ কর্মচারীর সাথে সাতজন ইহুদি কর্মচারীও নিয়োজিত ছিল। ১৯৪২ সালের মধ্যে কারখানার সম্প্রসারণের ফলে ইহুদী শ্রমিকের সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। কিন্তু ইহুদি সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে নাৎসিদের অত্যাচার বেড়ে যাওয়ায় শিন্ডলারের মনোভাব পরিবর্তিত হয়।তিনি বিভিন্নভাবে ইহুদিদের বাঁচানোর চেষ্টা করেন।
এসময় নাৎসিরা ক্রাকোর ইহুদিদের শ্রম শিবিরে স্থানান্তরিত করতে শুরু করেছিল, তখন ইজহাক স্টার্ন এবং আরও কয়েকশ কর্মচারী তাদের মধ্যে ছিল। তাদের ফিরিয়ে আনতে শিন্ডলার ট্রেন স্টেশনে দৌড়ে যান এবং আমন গোথ নামে একজন এসএস অফিসারের মুখোমুখি হন,অফিসারের কাছে যুক্তি দেন যে তার কর্মীরা যুদ্ধের জন্য অপরিহার্য। কিন্ত শিন্ডলার তার কথার জালে ফেলে তার কারখানায় নিয়োজিত কর্মীদের মুক্ত করতে এবং তাদের কারখানায় ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন।
ইহুদিদের রক্ষায় বিখ্যাত সেই শিন্ডলার’স লিস্ট
১৯৪৩ সালে নাৎসিরা ক্রাকোতে প্লাসজো ওয়ার্ক ক্যাম্প চালু করে শিন্ডলারের কারখানার কাছেই। এ ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিল দুর্ধর্ষ সেনা অফিসার আমন গোথ।যার নেশা ছিল ইহুদিদের হত্যা করা।কিন্ত শিন্ডলার গোথের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং যখনই তার কোনো কর্মীকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে নির্বাসন বা মৃত্যুদণ্ডের হুমকি দেওয়া হত, তখনই শিন্ডলার তাদের জীবন বাঁচানোর জন্য গোথকে ঘুষ প্রদান করত।
১৯৪৪ সালে প্লাসজোকে শ্রম শিবির থেকে একটি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে স্থানান্তরিত করা হয় এবং সমস্ত ইহুদিদেরকে অশভিটজের ডেথ ক্যাম্পে পাঠানো হয়। এ ক্যাম্পে ইহুদিদের গোসল করানোর নাম করে গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে হত্যা করা হত। শিন্ডলার গোথকে অনুরোধ করেছিলেন যেন গোথ তার কারখানাকে সুদেটেনল্যান্ডের ব্রনেকেতে স্থানান্তরিত করতে এবং যুদ্ধের পণ্য উৎপাদন করতে দেন।আর তখন গোথ শিন্ডলারকে বলেছিল যে তার সাথে যেসব কর্মীদের তিনি নিয়ে যেতে চান তার একটি লিস্ট করার জন্য।
ইজহাক স্টার্নের সহায়তায় শিন্ডলার ১২০০ জন ইহুদিদের নামের একটি তালিকা তৈরি করেছিলেন যাদেরকে তিনি নতুন কারখানার জন্য “প্রয়োজনীয়” বলে মনে করেছিলেন।এরপর অনুমতি দেওয়া হয় এবং কারখানা সরানো হয়।শিন্ডলার তার কর্মীদের উদ্দেশ্যমূলকভাবে ত্রুটিপূর্ণ পণ্য তৈরি করার নির্দেশ দেন যাতে সেগুলো যেন পরিদর্শন করতে না আসে। এর ফলে কারখানার এসব কর্মচারীরা যুদ্ধের বাকি মাসগুলো কারখানায় কাটানোর সুযোগ পান।
এভাবে কয়েকবার নিজের অর্থ খরচ করে শিন্ডলার ইহুদিদের হিটলার বাহিনীর থাবা থেকে মুক্ত করেন।অথচ একাজের সাথে তার কারখানার উন্নতির কোন সংযোগ ছিল না।আর এরকম চিন্তাধারার মাধ্যমে মানুষের প্রতি তার মহানুভবতার পরিচয় প্রকাশ পায়।
পরবর্তী জীবন ও মৃত্যু
বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময শিন্ডলারের স্ত্রী এমিলি ক্রাকোতে চলে আসেন এবং তার সাথে ইহুদিদের রক্ষায় যোগ দিয়েছিলেন।তিনি শ্রমিকদের জন্য সস্তায় রেশনের খাবার এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন।
১৯৪৫ সালের ৭ মে রেডিওতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের ঘোষণার মাধ্যমে শিন্ডলার জানতে পারেন জার্মানি আত্মসমর্পণ করেছে।কিন্ত যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরের দিন শিন্ডলার এবং তার স্ত্রী আগের গুপ্তচরবৃত্তির জন্য অভিযুক্ত হন।এসময় তারা বিচার এড়াতে আর্জেন্টিনায় পালিয়ে যান।
সেখানে গিয়ে নতুন করে ব্যবসা শুরু করেন।কিন্তু কিছুদিন পর ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায় এবং অর্থ সংকটে পড়েন।শিন্ডলার তখন তার কারখানার সেই ইহুদি শ্রমিকদের কাছে অর্থ সাহায্য চান।ফলে বেঁচে যাওয়া ইহুদিরা কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তাকে প্রচুর অর্থ সাহায্য করে।বাকি জীবন এভাবেই পার করেন শিন্ডলার।
একজন ক্যাথলিক খ্রিস্টান হয়েও ইহুদিদের প্রতি এ ভালোবাসার জন্য তাকপ ১৯৬২ সালে ইসরায়েল সরকার কর্তৃক Righteous Gentile by Yad Vashem এ অভিহিত করা হয়।১৯৭৪ সালে অস্কার শিন্ডলার মৃত্যুবরণ করেন।জেরুজালেমের মাউন্ট জিয়নের ক্যাথলিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
১২০০ ইহুদিদের রক্ষাকর্তা অস্কার শিন্ডলার নিজেই হিটলারের নাৎসি বাহিনীর সদস্য ছিলেন।কিন্ত হিটলার ও তার বাহিনীর ইহুদি নিধনের নামে বর্বরতাকে শিন্ডলার মেনে নিতে পারেন নি।নানাভাবে নিজের পদমর্যাদা আর বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে বারবার ঢাল হয়েছিলেন ইহুদিদের পক্ষে।
এজন্য ইহুদিদের কাছে শিন্ডলার হিরো।তবে তার এ অসামান্য কৃতিত্ব শুধু ইহুদি জাতিই নয়,বরং সারা বিশ্বের কাছে প্রশংসার দাবি রাখে।
১/দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে শিন্ডলারের জীবন