ছবির মতো সুন্দর এক প্রদেশের নাম অরুণাচল। ভারতের যে কয়টি প্রদেশ ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে টানে তার মধ্যে অরুণাচল একটি। দেশটির ২৯টি প্রদেশের মধ্যে সূর্যিমামা প্রথম উঁকি মারে অরুণাচল প্রদেশেই। এজন্য অরুণাচলকে ভারতের ‘ভোরের আলোকিত পাহাড়ভূমি’ বলা হয়। একে ‘প্রকৃতির গুপ্তধন’ও বলা হয়।
অরুণাচল প্রদেশকে এত সৌন্দর্যে সৌন্দর্যমন্ডিত করেছে কয়েকটি শান্ত, স্নিগ্ধ ও মনোরম লেক। লেকগুলো আপনার ভ্রমণের তৃষ্ণা মেটানোর পাশাপাশি কোমল আদরে ভুলিয়ে দেবে যান্ত্রিক জীবনের যত কষ্ট। সুন্দর এ লেকগুলো সম্পর্কে জানবো আজ।
গঙ্গা লেক
ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে অরুণাচল প্রদেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় একটি ট্যুরিস্ট স্পট হচ্ছে গঙ্গা লেক। স্থানীয়দের কাছে এটি গ্যাকার সিন্নি নামে পরিচিত। অরুণাচল প্রদেশের রাজধানী ইটানগর থেকে মাত্র ছয় কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
লেকটিকে ঘিরে রয়েছে একটি বিস্তীর্ণ শ্যামল বন, যা আপনার ভালো লাগতে বাধ্য। লেকটির চারপাশের গাছ, অর্কিড এবং ফার্ন উদ্ভিদের সৌন্দর্যে যেন যৌবন দান করেছে। লেকের পানিতে গাছের পাতা আর সূর্যের আলোর লুকোচুরি খেলা নিমিষেই নিয়ে যাবে এক কল্পনার জগতে। সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, চারপাশের সবুজ গাছগাছালি লেকটির পানিকে সবুজ রং উপহার দিয়েছে। ফলে লেকের পানি দেখতে পুরোটাই সবুজ।
নৌকায় ঘুরে বেড়ানোর সুবিধা ছাড়াও লেকটিতে রয়েছে ফ্যামিলি পার্ক এবং সুইমিং পুল। এছাড়াও একটি পিকনিক স্পটও রয়েছে এখানে। সোমবার ছাড়া পুরো সপ্তাহই দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে এটি।
অবস্থান: ইটানগর, অরুণাচল প্রদেশ, ভারত।
মাধুরী লেক
অরুণাচল প্রদেশের আরেকটি সুন্দর ও মনোরম লেকের নাম মাধুরী লেক। তাওয়াং বেড়াতে আসবেন আর মাধুরী লেক না দেখেই চলে যাবেন? তবে আপনার ভ্রমণ পুরোটাই মাটি মনে হতে পারে। তাওয়াংয়ের ‘অবশ্য দর্শনীয়’ একটি লেক হচ্ছে মাধুরী লেক। ১৯৫০ সালে ভূমিকম্পের ফলে লেকটির জন্ম। এর প্রকৃত নাম সঙ্গাসের লেক। তবে লেকটির নাম মাধুরী নামকরণ করা হয় ‘কয়লা’ সিনেমার শ্যুটিংয়ের পর থেকে। এ সিনেমার নায়িকা মাধুরী দিক্ষিতের নাম থেকেই লেকটির এ নামকরণ।
পাহাড় থেকে নামার সময় লেকটির সৌন্দর্য বর্ণনাতীত। চারটি পাহড়ের মাঝখানে লেকটি যেন আসন গেড়ে বসে আছে। বছরের অনেকটা সময় জুড়েই হিমায়িত হয়ে থাকে। লেকটিকে ঘিরে বেড়ে ওঠা পাহাড় আর হৃদয়কাড়া বাতাস যেন স্বর্গসুখের বার্তা নিয়ে আসে। পুরো লেকটি একবার চক্কর দিতে ৩০ থেকে ৪০ মিনিট সময় লাগে। এর পাশেই একটি সেনা ক্যাফেটেরিয়া আছে, যেখানে নুডলসের পাশাপাশি বেশ কিছু গরম খাবারের ব্যবস্থা আছে।
একে বেষ্টন করে রেখেছে সতেজ উপত্যকা এবং তুষারাবৃত পাহাড়, যা একে প্রাণ দান করেছে।
লেকটি ভারতীয় সেনাবাহিনী দ্বারা পরিচালিত। এপ্রিল থেকে অক্টোবর মাস হচ্ছে এখানে ভ্রমণের উপযুক্ত সময়। বিশেষ করে, বছরের শেষের দিকে লেকটি তুষারাবৃত থাকে।
অবস্থান: বুমলা রোডের কাছে, তাওয়াং, অরুণাচল, ভারত।
লেক অফ নো রিটার্ন
লেকটির নাম শুনেই বুকটা কেঁপে উঠতে পারে। রহস্যময় এই লেকটি ‘ভারতের বারমুডা ট্রায়াঙ্গল’ নামে পরিচিত। নামের সাথে মিল রেখে লেকটিকে নিয়ে বেশ কিছু গল্প প্রচলিত আছে, যা আপনার ভয়কে আরো বাড়িয়ে দেবে। কিন্তু সুন্দর এই লেকটি আপনার নয়ন জুড়াবে নিমিষেই।
মায়ানমারের নাগাস সীমান্তের শহর পানসৌ এলাকায় এবং ভারতের অরুণাচল সীমান্তে অবস্তিত এটি। এই এলাকাটি টাঙ্গস গোত্রের আবাসস্থল। ভারত ও বার্মার মধ্যকার সম্পর্কের উন্নতির কারণে লেকটি আকর্ষণীয় এক পর্যটন স্পট হয়ে উঠেছে।
লেকটির নামকরণ এবং এর পেছনে নানা গল্প প্রচলিত আছে। কথিত আছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এলিট ফোর্স জরুরি অবতরণের জন্য এ লেকটি ব্যবহার করেছিলো। এর ফলে অনেক বিমান এবং তাদের ক্রু এই লেকে নিমজ্জিত হয়েছিল।
আরো কথিত আছে, রহস্যময় এ লেকটির কথা জানা যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে। সে সময় এ অঞ্চলে একটি রাস্তা তৈরি হয়েছিল। এই রাস্তার কাজ শুরু হয় ১৯২৩ সালে। তখনই এ লেকের খোঁজ পাওয়া যায়। এর অলৌকিক ক্ষমতার কথাও ছড়িয়ে পড়ে অচিরেই। সেখানে যেসব মিলিটারি পাঠানো হতো লেকের কাছাকাছি যাওয়ার পরপরই সেগুলো অদৃশ্য হয়ে যেত। এসব ভূতুড়ে ঘটনা প্রকাশিত হবার পর ক্রমে স্থানটি সম্পর্কে সত্য-মিথ্যা বিভিন্ন কাহিনী লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে।
এক কাহিনীতে বলা হয়েছে, যুদ্ধ থেকে ফিরে আসা জাপানি সৈন্যরা তাদের পথ হারিয়ে এ লেকে এসেছিলো। এখানে তারা ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয় এবং লেকে ডুবে মারা যায়। এই গল্পগুলোকে ভারতীয় সংবাদপত্র এবং ভারতীয় উপন্যাসেও পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে।
লেকটির দৈর্ঘ্য ১.৪ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ০.৮ কিলোমিটার। লিডো রোড থেকে ২.৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এটি।
রহস্যময় নানা গল্প এবং এর আকর্ষণীয় সৌন্দর্যের কারণে দ্রুতই লেকটি আকর্ষণীয় পর্যটন গন্তব্যে পরিণত হয়। এটি মায়ানমার এবং ভারতের জন্য একটি সম্ভাবনাময় পর্যটন স্পট।
অবস্থান: পাঙ্গসৌ পাস, পাঙ্গসৌ, অরুণাচল, ভারত।
পাংকাং তেং সো লেক
পাংকাং গাছ থেকে লেকটির নামকরণ করা হয়েছে। মূল শহর থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এটি ‘পিটি সো লেক’ নামেও পরিচিত। গ্রীষ্মে লেকটিকে পরম আদরে জড়িয়ে রাখে নীলকান্তমণি ফুল। আর শীতে জড়িয়ে রাখে শুভ্র তুষার। এই লেকটিও ভূমিকম্পের সময় জন্ম হয়েছে। পাইন ফরেস্টের বুকে শান্ত জল নিয়ে জেগে আছে লেকটি। এর নীল জলে বনের মৃত গাছগুলো দেখতে অস্বাভাবিক সুন্দর। শীতকালে তুষারে ঢাকা থাকে লেকটি। শান্ত নীল জল, লেকের পাড়ের পাখিদের কলরব, তুষারাবৃত পাহাড়, চলন্ত মেঘের দল- সব মিলিয়ে অসাধারণ পরিবেশ। এটিও ভারতীয় সেনাবাহিনী দ্বারা পরিচালিত।
এপ্রিল থেকে অক্টোবর লেকটি ভ্রমণের উপযুক্ত সময়। কারণ, নির্জন হওয়ার কারণে গ্রীষ্মের এ সময়েও এর তাপমাত্রা যথেষ্ট কম থাকে। শহর থেকে ট্যাক্সিতে চড়ে সহজেই যাওয়া যায় লেকটিতে।
অবস্থান: ইএন রুট থেকে বুমলা পাস, তাওয়াং, অরুণাচল, ভারত।
নাগুলা লেক
তাওয়াং শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে এবং পাংকাং তেং সো লেক থেমে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এটি। এপ্রিল এবং মে মাস ছাড়া সারা বছরই প্রায় তুষারাবৃত থাকে। লেকের চারপাশে চোখে পড়বে অজস্র ব্রাহ্মিণী হাঁস। সীমান্তের খুব কাছাকাছি হওয়ায় এর আশেপাশে অগণিত সেনার উপস্থিতি চোখে পড়বে। লেকটির জলে তুষারাবৃত পর্বতের প্রতিচ্ছবি দেখতে অপরুপ। বেশিরভাগ সময়ই লেকটি তুষারাবৃত থাকে। লেকটি ভ্রমণের জন্য উপযুক্ত সময় হচ্ছে এপ্রিল-মে এবং সেপ্টেম্বর-অক্টোবর। এই লেকটিতে অতিথি পাখির সমাগম চোখে পড়ার মতো।
অবস্থান: তাওয়াং থেকে বুমলা, তাওয়াং, অরুণাচল, ভারত।
মেহাও লেক
সবুজ বনের মধ্যে প্রাকৃতিক মেহাও লেকটি অরুণাচল প্রদেশের রোইং থেকে প্রায় ১৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এই লেকটি ৪ বর্গ কিলোমিটারেরও বেশি এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। লেকটিকে সমৃদ্ধ করেছে এর আশেপাশের উদ্ভিদ এবং প্রাণীরা। ১৯৫০ সালের ১৫ আগস্ট ভূমিকম্পের ফলে প্রাকৃতিকভাবে এই লেকটির সৃষ্টি হয়। পরে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের গুনে এটি ক্রমশই রোইংয়ের একটি প্রধান পর্যটন গন্তব্য হয়ে ওঠে। ভূতাত্ত্বিকরা এর নাম দিয়েছেন অলিগোট্রফিক (নিম্ন পুষ্টিকর) লেক। কারণ এই লেকে কোনো মাছ নেই। এর পরিষ্কার জল এবং বন্য হাসের বিশাল সংখ্যা বিমোহিত করে তুলবে নিমিষেই। লেকটিতে নৌকায় চড়ে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ রয়েছে। তাছাড়া এর পাশ ধরে বনে ট্রেকিং অন্য এক অভিজ্ঞতার সুযোগ এনে দেবে।
অবস্থান: রোইং থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরে, অরুণাচল, ভারত।
লেখাঃ Uzzal Hossen | সূত্রঃ রোয়ার বাংলা