ভাবি ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে ভর্তার জন্য সেদ্ধ আলু হাতে টিপে টিপে ভাঙছে ও টেলিভিশনে ‘কাভি খুশি কাভি গাম’ দেখছে। পেছনে দাঁড়িয়ে আমি অপেক্ষা করছি একটা ব্রেক এর, মুভির মাঝখানে ডিস্টার্ব করলে ভাবি রাগ করেন। আবার যেকোনো মূহুর্তে ভাইয়া চলে আসারও আশঙ্কা আছে। তাই যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। ব্রেক দিলো, টেলিভিশনের স্ক্রিনে ‘বিনা গেস ওয়ালা ফগ’ এর বিজ্ঞাপন হচ্ছে। এখনই সময়।
আমি ড্রয়িংরুমে ঢুকে ভাবির পা ঘেঁষে ফ্লোরে বসে পরি। ভাবি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই আমি আমার মুখস্ত বুলি আওড়ানো শুরু করলাম।
:- ভাবি, আমার তো বাবা নেই। ভাইয়া আছেন, বড় ভাই বাপের সমান, আর তুমি যেহেতু আমার ভাবি, ভাবিও মা’র সমান, আর দেখো, আমার মা’ও নেই, সুতরাং এই ভুবনে আমার বাবা-মা আল্টিমেটলি তোমরাই, কী বলো?
ভাবি ‘মহিলা ইন্টেলিজেন্স’দের মতো ভ্রু বাঁকা করে চোখদুটো ছোট করে বললো :- তারপর বল!
আমার তেলমারা খুব একটা কাজে দিচ্ছেনা। আবার শুরু করলাম:- এই বাসাতে তো ভাইয়া, তুমি আর আমিই থাকি, তোমাদের যখন বেবি হবে, সে যখন পটি করে দিয়ে পেঁ পোঁ করে কাঁদবে, তুমি তখন রান্নাবান্না নিয়ে বিজি থাকবে, তখন কে তোমার বেবি সামলাবে? নিশ্চয় আমি? (ভাবির ইন্টেলেকচুয়াল চাহনির কোনো ব্যত্যয় ঘটছেনা, এদিকে আবার মুভিও শুরু হয়ে যাবে আবার ভাইয়াও চলে আসতে পারে, তাই আর না পেঁচিয়ে হুট করে বলেই ফেললাম) ভাবি আমার পাঁচশো টাকা লাগবে কালকে সকালে, নাদিয়াকে প্রপোজ করব। ওকে নিয়ে একটা ভালো রেষ্টুরেন্টে বসতে হবে। কিছু ফ্লাওয়ারস ও চকলেট কিনতে হবে। প্লিজ!
:- এটুকুর জন্য এতো নাটক! নরমালি বললেও তো হতে পারতো!
:- হয়তো হতো, কিন্তু পাংশা লাগতো, শ্রমসাধ্য সফলতা অধিক মিষ্টধর।
ভাবি হাসতে হাসতে সোফায় গড়াগড়ি খাচ্ছে, আর কথা’ই বলতে পারছেনা। এই মহিলার এই একটা সমস্যা। যখন হাসবে তখন ভুবন মাতিয়ে মন ভরে হাসবে আর যখন মুখ গোমড়া করবে তো করবেই, আমাদের দুই ভাইয়ের তখন রান্না করে খেতে হয়। মুড অন হতে দুই তিন দিন লেগে যায়। এর মাঝে উনাদের মধ্যে পরষ্পর কথাবার্তা যা হয় সব ডাক যোগে, আর আমি হয়ে যাই তখন ‘নির্বাচনকালীন সরকারে’র মতো বাসার ‘ঝগড়াকালীন সরকার’ ও অবৈতনিক খন্ডকালিন ডাকপিয়ন। বাসার উল্লেখযোগ্য কাজকাম ও উনাদের পরষ্পরের বার্তার আদান প্রদান আমাকেই করতে হয়। বাসায় তখন দারুণ পরিবেশ হয়, আমার একটা সুপ্রিম পাওয়ার থাকে তখন। আমাকেই সব ঠিকঠাক করতে হয় ছোটখাটো একটা ট্যুর, লংড্রাইভ কিংবা সারপ্রাইজ এরেঞ্জ করে।
ভাইয়া ও ভাবির বিয়ে হয়েছে পাঁচ বছর আগে। তখন আমি জে.এস.সি পরীক্ষার্থী। ভাইয়ার অফিস ছিলো আর বাসায় অন্যকেও না থাকায় ভাবি নতুন বউ হয়েও প্রতিদিন আমাকে পরীক্ষাকেন্দ্রে নিয়ে যেতো। ভাবির ছোট কোনো ভাইবোন ছিলোনা। উনার নাকি খুব আফসোস হতো ছোট একটা ভাই না থাকায়। সেই আফসোস তিনি খুব ভালো করেই মিটিয়েছেন। আমাকে তিনি আপন ভাইয়ের চেয়েও বেশি আদর করেছেন। ভাইয়া আর ভাবির অর্থ, সুখ ও ভালোবাসা সবই আছে। শুধু ঘর আলো করা একটা বাবু’র প্রয়োজন। উনারা ট্রাই করছেন ও বিভিন্ন মেডিক্যাল ট্রিটমেন্ট নিচ্ছেন। এখন সব উপর ওয়ালার হাতে।
যা’ই হউক, পরদিন সকালে নির্দিষ্ট টাইমে নাদিয়া এলো। আমার হাতে তিনশো টাকা দামের একটা ফ্লাওয়ার শেইপ ও চকলেটের বক্স। নাদিয়াকে নিয়ে ‘ব্লু চিজ’ রেস্টুরেন্টে গেলাম। খাবার অর্ডার করবো তখনই নাদিয়া বলছে “একটু ওয়েট করো প্লিজ” আমার বয়ফ্রেন্ড আসবে। আমরা একসাথে না হয় খাবার অর্ডার করি!”
আমার মাথায় ধপাস করে কেউ যেন মোটা বই দিয়ে আঘাত করলো। বলে কী মেয়েটা! আমি জানতেও চাইনি তার কোনো বয়ফ্রেন্ড আছে কিনা। দুদিনের চ্যাটিং এ ওকে প্রপোজ করতে চলে আসি। কী হাস্যকর!
নাদিয়ার কথা শেষ হতে হতেই ‘ইয়ো ইয়ো’ টাইপের একটা যুবক বাইক স্ট্যান্ড করিয়্র রেস্টুরেন্টে ঢুকলো। টেবিলের কাছে এসে আমাকে ‘হাই ব্রো, ওয়াটস আপ?’ বলে হাত বারিয়ে দিলো। আমি হ্যান্ডশেইক করলাম। তিনজন মিলে অর্ডার করলাম, আমি এক্সপেন্সিভ সব খাবার অর্ডার করাতে নাদিয়া ও তার বয়ফ্রেন্ডও অর্ডার করছে ধুমছে। আমার খাওয়া যখন প্রায় শেষ, আমি ফোনে টাইম দেখার ভান করে “ওহ শীট” বলে ফ্লাওয়ার ও চকলেট বক্স হাতে নিয়ে “আমার উঠতে হবে নাদিয়া, ইমার্জেন্সি।” বলে উঠে সোজা হেঁটে বেরিয়ে পড়লাম। এবার বিল দে, শালা পাঠা কোথাকার! আমার প্রপোজের ‘মাইরে বাপ’ করে দিলো। পাশের দোকান থেকে একটা সেন্টার ফ্রুট কিনে একটু চিবিয়ে নাদিয়ার বয়ফ্রেন্ড এর বাইকের সীটে লম্বা লম্বা করে এঁটে দিয়ে আসলাম।
ফুল আর চকলেট বক্স হাতে রিক্সা করে বাসায় ফিরছি। ভাবি এই কাহিনী শুনে হেসে কী কান্ড করবে সেটাই ভাবছি রিক্সায় বসে। বাসায় ঢুকে ভাবির হাতে ফুল ও চকলেটগুলো দিলে ভাবি ছোট্ট একটা হাসি দিয়ে বলে “ওয়েলকাম”।
আমার ভেতরটা মুচড় দিয়ে উঠলো। যতই মনখারাপ থাকুক ভাবি এতোটা সৌজন্যতা কখনো করেনা আমার সাথে। আমি কিছু জানতে না চেয়ে ও কিছু আঁচ করতে পারিনি ভান করে ভাবিকে আজকের ঘটনা সব খুলে বললাম। ভাবি খুব কষ্টে ঠোঁটে হাসি ধরে রেখে সব শুনলেন। এবং আমাকে সান্তনা দেয়ার সুরে বললেন:- “তুই চিন্তা করিসনা, তোকে খুব সুন্দরী লাল টুকটুকে একটা ডানাকাটা পরী বিয়ে করাবো। তোদের খুব সুন্দর পুতুলের মতো একটা মেয়ে বাবু আসবে। আমরা সবাই বাবুটাকে খুব আদর করবো। হেসেখেলে বাবুটা এই বাসাটাকে স্বর্গ বানিয়ে তুলবে।”
কথাগুলো বলার সময় ভাবির গলা কেঁপে উঠলো। হঠাৎ আমার মাথায় আসলো, আজকে ভাইয়া ও ভাবির রিপোর্ট দেয়ার কথা। আমি উঠে ভাইয়াদের বেডরুমে গিয়ে রিপোর্ট কার্ড খুলে দেখলাম। যে আশঙ্কাটা ছিলো, তা’ই। সমস্যাটা ভাবির’ই। ভাবি কখনো মা হতে পারবেনা। খোদার কাছে জীবনের সকল পুণ্যের বিনিময়ে আমি ভাবির জন্য দোয়া করেছিলাম। আমার পুণ্যের অনুপাতে হয়তো চাওয়াটা অনেক বড় ছিলো। আজ আমি কান্নায় বুক ভাসিয়ে আমার জীবনের বিনিময়ে হলেও ভাবির হাসিমুখ ভিক্ষে চাইছি খোদার কাছে। মায়ের মতো মানুষটাকে এভাবে সারাজীবন কাঁদতে দেখতে পারবোনা।
লেখা: Mubarak Husain Raju