অনুগল্প: রিমান্ডে একদিন

4530
0

ঘুমঘুম চোখে তাড়াহুড়ো করে ভার্সিটি যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হয়েছি। বাসায় গলি থেকে বের হয়ে বড় রাস্তাটার মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছি। প্রচুর ঘুম পাচ্ছে। চিন্তা করতে লাগলাম, “ভার্সিটি যাব নাকি বাসায় ফিরে যাব?”

আমার হয়েছে এক বদভ্যাস। কোনো কাজে নামার পর তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেষ্টা করি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছি। হঠাৎ খেয়াল করলাম আমার বামপাশে এক সুন্দরী মেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমি তাড়াতাড়ি সোজা হয়ে দাঁড়ালাম।

সুন্দরী মেয়েদের সাধারণত একা দেখা যায় না। কিন্তু মেয়েটি একা। চোখ থেকে ঘুম উড়ে গিয়েছে। এই মুহূর্তে মেয়েটি আমার অ্যান্টি-ঘুম হিসেবে কাজ করছে।
হাতের ঘড়ি দেখলাম। সাতটা পাঁচ বাজে। এতো সকালে এভাবে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে দেখে একা ফেলে যেতে ইচ্ছে হলো না।

আমিও দাঁড়িয়ে রইলাম। তবে মেয়েটির দিকে তাকাচ্ছি না আর। না তাকালে মেয়েটি আমাকে ভালো ছেলে ভাববে। ভালো ছেলে ভাবলে কোনো সমস্যায় পড়লে নিজ থেকে কথা বলতে আসবে। নিজ থেকে কথা বললে আমি বন্ধুত্ব স্থাপন করতে পারব। বন্ধুত্ব স্থাপন করলে সুযোগ বুঝে নাম্বার নিতে পারব। এরপর কথা বলতে বলতে প্রেমের প্রস্তাবও করে দিতে পারব।

অনেক বড় প্ল্যানিং নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ খেয়াল করলাম রাস্তার মানুষজন আমার দিকে অন্যভাবে তাকাচ্ছে। আমি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে মেয়েটার আরো কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ালাম।

এখন সবাই মনে করবে আমরা পরিচিত এবং আমি অন্যমনস্ক বলে ওর সাথে কথা বলছি না। পাঁচ মিনিট কেটে গেল কিন্তু মেয়েটা নিজ থেকে কিছুই বলল না। আমি নিজ থেকে কথা বলার জন্য শব্দ খুঁজছিলাম। এমন সময় দেখি মেয়েটা দৌড় দিল। সুন্দরী মেয়েদের আমি টিভিতেই দৌঁড়াতে দেখেছি। বাস্তবে সুন্দরী মেয়েরা সহজে দৌঁড়ায় না। মেয়েটা গিয়ে রাস্তার অপরপাশ থেকে আসা একটি ছেলেকে জড়িয়ে ধরল। আমি কি বাংলাদেশের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি নাকি আমেরিকার কোনো স্ট্রিটে দাঁড়িয়ে আছি?

আমি আমার হাতে চিমটি কাটলাম। না ঠিক আছে। মেয়েটা আর পিছন দিকে তাকালো না। তাড়াহুড়ো করে ছেলেটাকে নিয়ে গাড়িতে উঠে চলে গেল। মেয়েটা চলে যাওয়ার পর আমার মনে হতে লাগলো হয়ত মেয়েটা বাসা থেকে পালিয়ে এসেছে।

মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। আমার এত বিশাল পরিকল্পনা মাঠেই মারা গেল। জোরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘড়ির দিকে তাকালাম। আটটা বেজে গিয়েছে। জীবন থেকে মূল্যবান একটা ঘণ্টা হারিয়ে ফেললাম। ট্রেনও আর পাবো না। বাসে উঠলাম। জানালার পাশের সিটে গিয়ে বসলাম। বাস কিছুদূর এগিয়েছে এমনসময় দেখলাম পুলিশ চেকপোস্ট বসিয়েছে।

সকাল সকাল এসব দেখে মাথা আবার খারাপ হয়ে গেল। আমার পাশের সিটে বসা আংকেল আমাকে বললেন, পুলিশ মেবি কোনো চিহ্নিত সন্ত্রাসীকে খুঁজছে। দেখুন ছবি হাতে নিয়ে খুঁজছে।”

উনি কথাটা বলতে বলতে দুইজন পুলিশ আমাদের বাসে উঠল। আমার পিছন দিকে তাকিয়ে তারা একসাথে চিৎকার দিয়ে উঠল,” স্যার পাইছি।” আমি পিছনে তাকালাম। একজন ষাটোর্ধ বৃদ্ধ মানুষ বসে আছেন। তাহলে ইনিই সন্ত্রাসী? ছদ্মবেশ ধরেছে নাকি? এসব ভাবছিলাম হঠাৎ আমার কাঁধ ধরে কেউ ঝাঁকি দিল। পিছন দিকে তাকালাম। দেখি ৬-৭ জন পুলিশ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। একজন এসে জোরে থাপ্পড় দিল আমার গালে। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম। আমার পাশে বসা আংকেল এমনভাবে লাফ দিয়ে সরে গেলেন যেন আমি কোনো জঙ্গিসদস্য। সেই পুলিশ কষে আরেকটা থাপ্পড় দিল আমাকে।

জ্ঞান হারালাম আমি।

কতক্ষণ অজ্ঞান ছিলাম জানি না। জ্ঞান ফিরার পর খেয়াল করলাম আমি জেলখানায় রয়েছি। মুখে নোনতা স্বাদ। থুথু ফেলে দেখি রক্ত বের হচ্ছে। এমন সময়য় একজন পুলিশ এসে দেখে গেল আমাকে। জ্ঞান ফিরেছে দেখে সে বাকী পুলিশদের ডাক দিল।
তিনজন পুলিশ আমাকে ধরে তুলে একটা চেয়ারে শক্ত করে বাঁধল। এখনো স্বপ্ন দেখছি কিনা বুঝতে পারছি না আমি। চিমটি কেটে দেখারও কোনো সুযোগ নেই। দুইহাত বাঁধা রয়েছে।

কিছুক্ষণ পর একজন ভূঁড়িওয়ালা পুলিশ আসলো। দেখেই বুঝলাম উনি বড় অফিসার। আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। কিন্তু কি জিজ্ঞেস করবেন? কেন নিয়ে এসেছে আমাকে? আমি কিছুই জানি না।
আমার সামনের চেয়ারে বসলেন তিনি। চোখ দুটো বড় বড় করে তাকালেন তিনি এবং জিজ্ঞেস করলেন,” নাম কি তোমার?”

আমি উত্তর দিলাম,” অভি মহাজন।”
তিনি ব্যঙ্গ করে বললেন,” কাজকর্ম এতো অমহাজনীয় কেন?”
এই অমহাজনীয় শব্দটা আগে কখনও শুনিনি। এই প্রথম শুনলাম। মাথায় নোট করে রাখলাম। এখান থেকে বের হয়ে জেনে নিতে হবে।

আমি বললাম, ” কেন স্যার? ”
তিনি বললেন,” সত্যি কথা বললে তোমাকে এখুনি ছেড়ে দিব। বল, মেয়েটা কোথায়?”

কার মেয়ে? কিসের মেয়ে? তাছাড়া এই পুলিশকে দেখে আমার মোটেও ভয় লাগছে না। কেমন যেন হাসি আসতে চাইছে। আমি বুঝলাম না এধরনের পরিস্থিতিতে হাসি আসবে কেন?
তবুও আমি নম্রভাবে উত্তর দিলাম,” স্যার কোন মেয়ে? আমি তো কিছুই জানি না। কোথাও ভুল হচ্ছে হয়ত আপনাদের।”

আমার কথা শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন তিনি। হাতের কাছে একটা লাঠি ছিল। সেটা নিয়ে তিনি চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ালেন। এদিকে আমার যায় যায় অবস্থা।
তিনি দাঁড়িয়ে বললেন,” এবার শেষ সুযোগ দিচ্ছি তোকে। সত্যি কথা বল নাইলে বাকি জীবন জেলে কাটাতে হবে তোকে।”

একটু আগে তুমি করে বলছিলেন তিনি। এখন সেটা তুই এ নেমে এসেছে। পরিস্থিতি সংকটজনক অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। তিনি যে লাঠি হাতে নিয়েছেন তার হালকা বাতাস লাগলেই আমার শরীর ফেটে যাবে।
আর আমার শরীরে রক্ত এতোই কম যে ৪-৫ টা মশা একসাথে আমার শরীরে বসলে আবার রক্ত দিতে হবে আমাকে। সেখানে এই লাঠির আঘাতে পাঁচ মিনিটেই মারা যাবো আমি।

এবার কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললাম,” স্যার কোন মেয়ের কথা বলছেন প্লিজ সেটা একটু বলুন। ” তিনি এবার রেগে গিয়ে বললেন,” কেন সকালে মেয়েটাকে নিয়ে রাস্তায় এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলি আর তাকে তার প্রেমিকের হাতেও তুলে দিলি আর এখন সব ভুলে গেলি?”
এতক্ষণে বুঝলাম কেন এতকিছু। আমি তাড়াতাড়ি লাফিয়ে উঠে বললাম,” স্যার আপনার ভুল হচ্ছে। আমি তখন বাসের জন্য দাঁড়িয়েছিলাম। মেয়েটাকে আমি চিনি না।”

পাশে দাঁড়ানো পুলিশগুলো তামাশা দেখছিল। এদের একজন বলে উঠল,” স্যার আমার হাতে ছেড়ে দেন। শালাকে কিভাবে ঠিক করি দেখেন। ডিমথেরাপি দিলে সব গড়গড় করে বলে দিবে।”
আরেকজন বলে উঠল,” স্যার রড গরম করে ঠাণ্ডা দিকটা পিছন দিকে ঢুকিয়ে দেন যাতে হাত দিয়ে টেনেও আর বের করতে না পারে। ”

ছিঃ! কি বিকৃত মানসিকতা।

তবে থেরাপিগুলোর নাম শুনে বেশ হাসিও পাচ্ছিল। ডিমথেরাপি, রডথেরাপি এসব কত উন্নত মস্তিষ্কের চিন্তা তা ভাবতে লাগলাম। মুষলধারে কিছুক্ষণ কিলঘুষি চলল আমার উপর। মাগো, বাবাগো বলে কিছুক্ষণ চিৎকার করে আমি নিশ্চুপ হয়ে পড়ে রইলাম। একজন পুলিশকে দেখলাম কয়েকটা সিদ্ধ ডিম নিয়ে এসেছে। যে ডিমথেরাপি নিয়ে এতদিন হাসাহাসি করতাম আজ সেই ডিমথেরাপি আমার উপর প্রয়োগ হতে যাচ্ছে। ভাবতেই গা শিউরে উঠছে।

এমন সময় একজন পুলিশ এসে বলে গেল, “স্যার ওদের পাওয়া গিয়েছে। ওকে ছেড়ে দেন। ওর সাথে এই ঘটনায় কোনো সম্পৃক্ততা নেই।” মনে মনে আনন্দে লাফিয়ে উঠলাম আমি। আমাকে ধরে আবার চেয়ারে বসানো হলো। একটু আগে যে ডিম আমার পিছন দিকে দেওয়ার জন্য আনা হয়েছিল এখন সেই ডিম আমাকে মুখ দিয়ে খেতে দেওয়া হয়েছে।

আহা! পৃথিবী কতই অদ্ভুত। আমি খেলাম না। আস্তে আস্তে থানা থেকে বের হয়ে এলাম। বাসে ঠিকমতো বসতে পারি না । সারাশরীর ব্যাথা হয়ে গিয়েছে।
কোনোমতে বাসায় এসে কেউ না দেখেমতো নিজের রুমে চলে এলাম। ছোটভাই দরজা খুলে দিয়েছিল বলে মা আমার বিপর্যস্ত অবস্থা দেখেনি। ভালোমতো ফ্রেশ হয়ে শরীরে মলম লাগালাম। একটু পর মা ভাত খেতে ডাকল। সারাদিন এতোকিছুর পর আর খেতে ইচ্ছে করছে না। তারপরও অনিচ্ছাসত্ত্বে মাকে জিজ্ঞেস করলাম,” কি রান্না করেছো?”

মা রান্নাঘর থেকে উত্তর দিলেন, ” ভাত পরে খাস। তোর প্রিয় দেশি মুরগীর ডিম অমলেট করেছি। খেয়ে যা।”

লিখেছেনঃ অভি মহাজন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।