মোমের আলো

4606
0

অনার্সে কেবল ভর্তি হয়েছি। তখন বাবা মায়ের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিয়ে তাদের পছন্দ করা মেয়েটাকে বিয়ে করার মত দিয়ে দেই। আমি বিশ্বাস করতাম তাদের পছন্দই আমার জন্য অধিক ভালো হবে। আমার বিশ্বাস তাদের দৃষ্টিতে সেরা ও সুন্দর মেয়েটাকেই আমার জন্য ঠিক করবেন। সে বিশ্বাসে আমি কনে না দেখেই ‘হ্যাঁ’ বলে দিয়েছিলাম।

তারপর বিয়ের দিন যখন শেরওয়ানী পাগড়ি পড়ে বসে ছিলান স্টেইজে, খুব অদ্ভুদ লাগছিল। শশুড় বাড়ির এলাকার লোকজন আমাকে দেখে কি যেন সব বলছিল। আমি ভাঙা ভাঙা দু’চার শব্দ শুনেছিলাম। তা ছিল এই, “কি মেয়ের কি জামাই! কপাল যে কার ভালো আর কার খারাপ বুঝছিনা, বাপু!” আরো আরো কথা।

কাজী সাহেব আসলেন। আমার আবার এত বনিতা ভালো লাগে না। যখনই কাজী সাহেব বললেন, বলুন আলহামদুলিল্লাহ্‌। আমি চটজলদি বলে দিলাম, ‘আলহামদুলিল্লাহ্‌, আলহামদুলিল্লাহ্‌, আলহামদুলিল্লাহ্‌’। উপস্থিত সবাই বলে উঠলেন “আলহামদুলিল্লাহ্‌”।

মিষ্টি বিতরণ হলো। খাওয়া দাওয়া হলো। বিয়ে পড়ানো হলো। আমার কোন ছোট বোন ছিলনা যে তাকে জিজ্ঞাসা করবো, ‘বউ কেমন দেখলি?’ বন্ধুদের ও জিজ্ঞাসা করছিলাম না, নিজের লজ্জা ভেঙে!

বিয়ে শেষে কিছু আনুষ্ঠানিকতা বাকি ছিল। আমি ঠিক জানতাম না কি কি করতে হবে। আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো একটা ঘরে। যে ঘরে কনে বসে ছিল সেই ঘরে। কনের পাশেই আমাকে বসিয়ে দেওয়া হলো। তারপর কত কিছুর কুসংস্কার এর চর্চা যে হলো ঠিক বলে বুঝাতে পারবো না। সাহস করে সেসবের বিরোধিতাও করতে পারছিলাম না।

শেষের দিকে সবাই আমাদের দাড় করালেন, বললেন নামাজ আদায় করতে। আমি এবার আর কিছু না বলে থাকতে পারলাম না। সবাইকে উদ্দেশ্য করে বুঝিয়ে বললাম, ‘আমাদের নামাজ আমাদের উপর ছেড়ে দিন। আমরা পরে একান্তে পড়ে নিবো। এখানে পড়ার পরিবেশ নেই।’ সবাই সম্মত হলেও দুই একজন মনঃক্ষুণ্ণ হলো তা বুঝতে বাকি রইলো না। তবুও তারা তেমন জোর না করে চুপ করে রইলেন। এবার আমাদের বসিয়ে দেওয়া হলো। তখনো আমি সাহস করে তার মুখখানা দেখতে পারছিলাম না। আসলে তার হাতের দিকে তাকাতেও কেন যেন লজ্জা পাচ্ছিলাম।

তারপর বাকি আনুষ্ঠানিকতা শেষে তাকে নিয়ে বিদায় নিলাম তার পরিবার থেকে। তখন অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল। চারপাশ নিস্তব্ধ। সে নিস্তব্ধতা ভেঙে দিলো কারো হু হু কান্নার শব্দ। তারপর গাড়িতে উঠে গেলাম। আমি তখনো তার দিকে তাকাইনি। তাকাতে পারিনি। সাহস হয়নি তার চোখে চোখ রাখার। গাড়িতে পাশাপাশি বসে ছিলাম। খানিক অন্ধকার। আবছায়া আলোয় একবার তাকিয়েছিলাম। কিন্তু চেহারা ভালো বুঝে উঠতে পারিনি।

গাড়ি চলছে আমার বাড়ির পথে। গভীর রাত। তার মাথা আমার কাঁধে। অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করছিল। এমন ভালো লাগা মুগ্ধ হওয়া হয়ে উঠেনি আমার জীবনে কখনো। তখন আমার বয়স ও খুব বেশি হয়নি। মাত্র ১৯ বছরের বালক আমি। যার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে, তার বয়স শুনেছিলাম ১৭, মা বলেছিল।

আমি তখনো আমার সব কিছু গুছানো শিখিনি। এর মধ্যেই নতুন একজন মানুষ আমার কাঁধে মাথা রেখে নির্ভয়ে ঘুমাচ্ছে। সারাজীবন নির্ভয় আশ্রয়স্থল আমি। আজকেই সে দায়িত্ব আমার কাঁধে তুলে নিতে হলো। যে আমাকে তার আশ্রয় ভাবছে, তার সম্পর্কে আমি বেশি কিছু জানিনা। বাবা মা কে কিছুই জিজ্ঞাসা করতে পারিনি, লজ্জায়। শুধু আলোচনায় নামটা শুনেছিলাম। আয়শা। আমার কাঁধে মাথা রাখা মেয়েটার নাম আয়শা। আমার বউ আয়শা।

বাড়ি ফিরে যেতেই সবাই নতুন বউকে নিয়ে মেতে উঠে। মা চাচীরা নতুন বউকে বরণ করে নেয়। আমিও বরণ হই নতুন করে। চাল, ধান, দূর্বা ঘাস, আরো কি কি দিয়ে বরণ করে। এসবও কুসংস্কার জানি। বিরোধিতা করতে পারিনা। দুধ দেয় এক গ্লাস দুইজনকে। পান করে ঘরে যাই। তখনো আমি আয়শাকে ভালো করে দেখিনি। ইচ্ছে হচ্ছিল সব কিছু থামিয়ে দিয়ে এক পলক দেখি। আয়শা কি খুব সুন্দরী। মায়াপরী!

তারপর শেরওয়ানী পাগড়ি মালা সুতো সব খুলে স্বাভাবিক পোশাক পড়ি। মা চাচীরা নতুন বউকে নিয়ে সাজানো বাসর ঘরে তুলে দেয়। আমার ডাক পড়ে তার কিছুক্ষণ পরেই। আমি লজ্জায় মাথা নুইয়ে ঘরের দরজা ধাক্কা দেই খুব শক্ত করে। ভেবেছিলাম ভিতর থেকে হয়তো কেউ আটকিয়েছে। কিন্তু এটা ভাবিনি যে অনেক রাতে ছোটরা সব ঘুমিয়ে গেছে। আমার এহেন কান্ড দেখে দূরে দাড়িয়ে থাকা সবাই হেসে দেয়। কেউ মুখ লুকায়ে হাসে। আমি লজ্জিত হয়ে ভিতরে ডুকেই দরজা বন্ধ করে দেয়।

দরজা বন্ধ করেই ফিরে তাকাই বিছানার দিকে। ওখানেই আয়শার থাকার কথা। কিন্তু না, আয়শাকে দেখলাম মেঝেতে জায়নামাজ বিছিয়ে বসে আছে। আমি এবার আসল লজ্জাটাই পেলাম। আমি তো অজু ছাড়াই এ ঘরে চলে এসেছি। আমাদের তো নামাজ পড়ার কথা। আয়শা বসে আছে মেঝেতে। দরজার শব্দ হলেও তাকায়নি এদিকে। আমি আবার দরজা খুলে বাহিরে গেলাম। বাহিরে বসে থাকা আত্মীয় স্বজনদের চোখ এড়ানো দ্বায়। তাদের চোখের সামনে দিয়েই অজু করতে গেলাম। অজু করে আবারো ফিরে এলাম। এবার তাদের দিকে তাকাইনি একবারো।

ঘরে ডুকেই দরজা বন্ধ করে দাড়িয়ে দেখি আমার জন্য জায়নামাজ একটা সামনে বিছানো আছে। আমি গিয়ে দাড়াই ওখানে। তারপর আয়শাও আমার পিছনে দাড়ায়। আমি এই প্রথম নামাজের ইমামতি করি। আয়শা আমাকে অনুসরণ করে।

নামাজ শেষ করে মনে অনেক সাহস সঞ্চার করে পিছন ফিরে তাকালাম এই আশায় যে এবার আয়শাকে আমি দেখবো। যখনি মাথা ঘোরালাম তখনি বিদ্যুৎ বিভ্রাট হলো। চার দিক আঁধার হয়ে গেল। আর তাকে দেখতে পেলাম না। চুপ করে আঁধারের মধ্যে জায়নামাজে বসে আছি। কতক্ষণ বসে ছিলাম জানিনা, তবে মনে হলো কয়েক শতাব্দি পরে এক ম্যাচের কাটির খুচায় চারদিকের আঁধার ছেদ করে আলোকিত করলো মোমের সুঁতো। সেই মোমের আলোয় প্রথম দেখেছিলাম আয়শার মুখ।

নাকে নত, কানে দুল, মাথায় টিকলি, আর বিয়ের শাড়ি। সাদামাটা চোখে শুধু কাজল, কালো এলোমেলো ভ্রু, চিকন ঠোঁট আর সেই ঠোঁটের ভিতর এক পাটি সাদা দাঁতের মন মাতানো মিষ্টি হাসি। আমি তখনো বসে আছি জায়নামাজে। কোথা থেকে যে কথা শুরু করবো ভাবতেই পারছিলাম না। হৃদপিন্ড জোরে জোরে চলছিল। বুকটা ধব ধব কাঁপছিল।

আয়শা ধীরে ধীরে আমার কাছে এসে সামনে জায়নামাজে বসলো। আমি বিমোহিত হয়ে তার দিকে নিরবে তাকিয়েছিলাম। কতক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম জানিনা। নিরবতা ভেঙে দিয়ে সেই আমাকে প্রথম বলেছিল, “আসসালামু আলাইকুম!” এতক্ষণ তার রূপ দেখে বিমোহিত হচ্ছিলাম। এখন তার কন্ঠ শুনে আরো আকর্ষিত হলাম। এমন মিষ্টি নারী কণ্ঠ আমার জীবনেও শুনিনি। আমার বাবা-মার জন্য অনেক অনেক দোয়া যারা আমার জন্য এমন একটা মেয়েকে বেছে নিয়েছেন। আল্লাহকেও অনেক ধন্যবাদ দিলাম মনে মনে এমন একটা মানুষকে আমার জন্য বরাদ্ধ রাখার জন্য।

সে আবারো আমাকে সালাম দিলো। আমি সালামের উত্তর নিয়ে চুপ করে রইলাম। কি বলবো ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তারপর সে আমাকে বললো পরিচিত হতে, কারণ সে আমার সম্পর্কে বেশি কিছু জানেনা। আমিও তাকে বললাম আমিও বেশি কিছু জানিনা শুধু নাম টি ছাড়া। সে তার সম্পর্কে বলতে লাগলেন। আমি শুনছিলাম আর মুগ্ধ হচ্ছিলাম। এও কি সম্ভব!

আয়শা ছিলেন একজন কোরআনের হাফেজা। ৭ বছর বয়সেই হাফেজা হয়েছিল। তারপর আলেমাতে কেবল ভর্তি হয়েছে। আমার অনুমতি থাকলে সে আলেমা শেষ করতে চায়। তারপর আমি আমার পরিচয় দিতে লজ্জা পাচ্ছিলাম। কি দিবো আমার পরিচয়। অনার্স এ ভর্তি হওয়া একটা ছেলে মাত্র। না আছে কোন যোগ্যতা। না আছে তার তুলনায় জ্ঞান! আমি যেন তার তুলনায় বিশাল নদীর বুকে এক টুকরো সামান্য বালুর চর। যার মাঝে আছে কেবলি মরিচিকা।

তার এলাকার লোকেরা কেন ওসব কথা বলেছিল তা আমি বুঝতে পারছিলাম মাত্র। তারপর চুপ করে রইলাম। আমি কোন কথা বলছিলাম না। আমি আসলে তার যোগ্য ছিলাম না। আমি এসব ভাবতে ভাবতেই সে বলেছিল, “থাক আপনার আর পরিচয় দিতে হবে না। এখন থেকে আপনার সবচেয়ে বড় পরিচয় হচ্ছে আপনি আমার স্বামী। আমাকে কখনো ভুলে যাবেন না, কষ্ট দিবেন না, এই কথাটা আমাকে দিন।”

আমি তাকে একটা শর্ত এঁটে দিলাম। যদি আজকে আপনার তেলাওয়াত শোনান তাহলে কথা দিব। তারপর কোরআনের সূরা আর-রহমান তেলাওয়াত করে আমাকে শোনালেন। আমি এতটাই মোহিত হয়ে শুনেছিলাম যে এরপর থেকে আয়শার কন্ঠে তেলাওয়াত না শুনলে আমার রাত অস্থির হয়ে উঠতো।

পরের দিন মাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “মা, এমন হুজুর বউ এনে দিলে এই খেজুর ছেলেকে তার কারণ টা কি?” মা হেসে বলেছিলেন তোর বাবা এই মেয়ে জন্মের পরই ঠিক করেছিল। তোদের দু’জনের বাবা সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। যা এখন বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র!

তারপর অনেক বছর কেটে যায়। আমাদের সংসারে দু’টি জান্নাত এসেছে ঘর আলো করে। আয়শা তাদেরকেউ তারই মত করে গড়ে তুলেছে। আমি হলাম মোম, আয়শা সে মোমের সুঁতো, আর আমাদের মেয়েরা হলো মোমবাতির আলো। যাদের আলোয় আলোকিত হয় আমাদের চারপাশ।
.
.
.
.
অনুগল্পঃ
লিখেছেনঃ Arfin Rafi Shohel