মধ্যবিত্ত ভীরু প্রেম

4357
0

ময়মনসিংহ শহরটা ছিল প্রেমিকার মতন। যে প্রেমিকা কোন আবদার করে না, অসহায় কোন মেয়ে, যার সাধ জাগে আমাকে অনেক দিতে সাধ্যে হয় না। গলায় খড়ি ওঠা স্যাঁতসেঁতে শ্যামলা মেয়ে- অথচ কি রূপ তার! সে প্রেমিকার ঐশ্বর্য নেই, সেই সাথে আসা সহজাত সপ্রতিভতাও নেই- আছে কেবল একজোড়া দিশাহারা বড় বড় চোখ। এই চোখ পুঁজি করেই সে প্রতি পলে যেন জাপটে রাখে। সে প্রেমিকা, অথচ শাড়ির আঁচলে মা মা গন্ধ। পকেটে দু’আনা পয়সা ছাড়া উপস্থিত হওয়া যায় নির্দ্বিধায়। ঝকঝকে একমুখ হাসি, চোখ চকচক করে ওঠা আর…। আমি যেন পৌঁছুবার পথ থেকেই সবটা ভেবে নিতে পারি! পকেটের শূন্যতা, জীবনের দীনতা সবটা ওর কপালে, ঘাড়ে গছিয়ে দেয়া যায়। এই দেবীমূর্তি মানবীর যখন দু’দিন আমাকেই না দেখলে বুক টনটন করে, প্রিয় চোখে অভিমান জমে- তখন আর আমার কথা নাইবা বলি। ওর চোখের ছটফটানি যখন আমার চোখে এসে স্থির হয়- সে পূর্ণতার স্বাদ প্রেমিকমাত্রেই জানেন।
.
এই প্রেমিকার সাথে, শহরটার সাথে সম্পর্ক ছিল প্রায় দু’বছর। এরপর ঢাকা চলে আসি। চলে আসবার দিন, সব ছেড়েছুঁড়ে এসে পড়বার দিন, সেই বিকেল। ঢাকার বাস ধরব বলে রিকশায় ওঠা। সাথে সাথে গভীরে কোথাও একা হয়ে যাবার আত্মোপলব্ধি। হুট করে বুঝে ফেলা অনেক কিছুই আর চাইলেই হবে না এ শহরে। আমার ভেতরে। রেল যাবার ছলনায় রিকশায় আর খানিকক্ষণ বেশি আটকে রাখল প্রেমিকা শহর। দিশেহারা দেবীচক্ষু প্রেমিকা আমার! কাচারিঘাটের যে দোকানটায় চা খেতাম সেটার পাশেই গজিয়ে উঠল প্রকান্ড বটগাছ যার চারিধার নদী দিয়ে ঘেরা। খোঁজাখুঁজি করলে হয়ত এক আধটা পারিজাতেরও সন্ধান মিলবে। জানি না কেমন দেখতে এই ফুল, তবে গন্ধটা নিশ্চয়ই জন্মে প্রেমিকার বুকের ভেতর থেকে। স্টেশনের সেই বাজে লাইন, যেখানে আর রেল চলবে না বলে হাঁটতাম অথবা.. এই রাস্তাঘাট! যে ড্রেনটা দেখলে বুঝতাম প্রায় পৌঁছে গেছি… থাক সেসব কথা। ঢাকায় চলে এলাম।
.
ঢাকা বড় শহর। মহানগর। মফঃস্বলের মতন এখানে বিকালের রোদ গায়ে মাখবার আলসেমী ফুরসত নেই। গোধূলির আগেই সারি দিয়ে ল্যাম্পপোস্ট রাত্রিকে অস্বীকার করে এগোয়। আমিও ভীড়ে মিশে যেতেই চেয়েছিলাম, পারিনি।
.
যে শহরে প্রেয়সী নেই, প্রেমিকের কাছে সে শহর যেমন অর্থহীন, ফুটপাথের পাশ দিয়ে রিকশায় শ’য়ে শ’য়ে অনিন্দ্যসুন্দরীরা বয়ে গেলেও চেনামুখটি আর এক মুহূর্ত বেশি দেখে ফেলবার আশ্বাস নেই- তাই, কে ঠিক ‘ও’র মতন করে হাঁটছে, কোনজনের চুলগুলো একদম ওরই মতন এসব ছাড়িয়ে যায় সে। সে তুলনায় আমার যেন বিরহের ব্যথাও বাজতে লাগল আবার এদিকে শহরের ইতিউতি এখান ওখানটা দেখে থমকেও যেতে লাগলাম। নিউমার্কেটের বাংলা যেন নতুনবাজার! সত্যি, অটোতে বা বাসের এক কোনায় বা পৃথিবীর যেকোনো কোথাও, জীবনের নানান পথে আমাদের যে মুখ হাঁ করা এক অসম্ভব অসহায় একলা লাগার, নিজেকে নতুনতর তুলনাহীন একা অনুভব করা যার কোন উত্তরণ নেই কোন উত্তর নেই সেই সময়গুলোর প্রতিনিয়ত আঘাত আমাদের চোখে আঙুলে টের পাইয়ে দেয় মানুষ কত সস্তা!
.
আমার ঘরের পাশের ঘরটা মা’র। মরে যাওয়ার আগে থাকতেন। এখন খালি পড়ে। বাবা থাকেন তার পাশের ঘরটায়।অপদার্থ ছেলের মুখ খুব একটা দেখতে চান না, আর আমিও ঘর থেকে বেরই না। এরকমই চলছে। সুতরাং! আমি একটা গল্প ভাবলাম। যে কি না দিনদুনিয়া থেকে স্বেচ্ছা বিতাড়িত, মানুষের সঙ্গ সহ্য করে না এরকম একটা লোক। দিনের পর দিন কেটে যায় একা। সারাজীবন এমনই একলা থেকে যাওয়ার ভয় হয় না এমন লোক বিরল হতে পারে, গল্পের সেই ছেলেটা, ধরা যাক, নাম বিড়াল, তার এই ভয় নেই। তার কিছু যায়ই আসে না। শুধুমাত্র যৌনতাহীনতা থেকে বাঁচার জন্যেই যে একটি প্রেম খুঁজে বের করে। আর, মেয়েটির জীবনের দুঃখ মোটে দুটো। তাও শৈশবের সাথেই ধুয়েমুছে গেছে। প্রথমটি সিনেমার শেষ সিনে নায়ক নাহয় নায়িকার অনর্থক মরে যাওয়া আরেকটি হল, স্কুল থেকে ফিরে টের পাওয়া বড় ভাই নোসিলার বয়াম ফাঁকা করে দিয়েছে। অবশ্যই পরেরটা বেশি পেইনফুল। মেয়েটির প্রেম এসেছে, সামনেও আসবে তা নিয়ে কোন আপত্তি নেই। বলা বাহুল্য, প্রেমের সাথে যৌনতাও আসে।
আমজনতার রায়ে কুরুচিপূর্ণ এই কনসেপ্ট যেখানে শাশ্বত প্রেমের আইডিয়াকে চরম অপমান করে এগিয়ে চলে ভালবাসা ফর সেক্স’স সেক এর গল্প আমার মাথায় কেন এসেছিল তা আমি বলতে পারি না। লিখতে লিখতেই আমার মাথায় চুরমার হচ্ছিল। দুজনেই দুজনকে টের পায়, তবু প্রথম ক’দিন ন্যাকা তাকিয়ে থাকা দুজনের অসহ্য বোধ হয়, হাত ধরার কথা মনে পড়ে না, কথা বলবার মতন কিছু খুঁজে পায় না- কি কদর্য প্রয়াস! অবশেষে ইচ্ছেপূরণ। আবারো ইচ্ছেপূরণ। আবারো দুজনে যার যার পথে। বলা বাহুল্য, আমার প্রেমহীনতার বিতৃষ্ণা এসে জমায়েত এই গল্পে। হায় হায়রে দিন যায় রে ঘরে আঁধার এই ভুবন। মনের সুখে নিঃস্ব হলাম। যখন আমার আর কিচ্ছুটি রইল না প্রেম বলে তখন অবাক দেখলাম, গল্পের মেয়েটি রিকশায় উঠছে একটা বেঁটে-বামুনের সাথে। এতকাল যে তীব্র পাত্তা না দেয়া চাহনিতে সে তুচ্ছ করেছিল প্রেমের আহ্বান, সেই একই চাহনীতে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলছে লোকজনের, সমাজের বক্র চোখ, কামুক হাহাকার। হীরেকাটা ছুরির নিচে কে বা নুড়ি পাথর আর কেইবা সোনার টোপর।
.
না, আমি কাব্যি ফলিয়ে বলিনি, সত্যিই মেয়েটিকে দেখেছি সেদিন। রিকশায় উঠতে, সাথে বামুন লোকটা। আমি দোকানে গিয়েছিলাম, ফেরবার পথে। দেখামাত্রই চিনে ফেলি। নিজের গল্পের চরিত্র সামনে দিয়ে চলে যাওয়া অন্যরকম লাগে আসলে। আসলে পরে ভেবে দেখলাম আমি দোকানে কেন যাবো? আমার সব গুলিয়ে যাচ্ছে। আমি বের হইনি বোধহয়। আচ্ছা, আমি তো সত্যিই দেখেছি… দু’দিন আমি ঘরের বাইরে হইনি অথচ ওদের দেখেছি গতকাল।
.
আমি বন্যাকে ডাকলাম। সন্ধেবেলা। তাই বোধহয় বারান্দায় ছিল। সেই বড় বড় দিশেহারা চোখ, গিন্নীর মতন পেঁচিয়ে পরা শাড়ি- খুব চেনা মুখ আমার। আমি ওকে বললাম সবটা। সে ঠোঁট টিপে হাসল।
: হাসছ!
: না। হাসছি না, কাঁদছি।
.
সব অদ্ভুত বোধ হচ্ছে। এ কে? যেদিন দরজা দিয়ে ঢুকল একবারও তো আর কিছু ভাবিনি। এত চেনা! কি বলব! একসাথে হেসেছি, উঠে গিয়ে জাপটে ধরা, দুজনে মিলে রাঁধতে বসা। এসব বেশিদিনের কথা না বোধকরি, অথচ মনে তো আর কিছু নেই! কেমন একটা সংসার সংসার খেলা। ট্যাপ থেকে সবেগে পড়তে থাকা জল ছাকনীর ভেতর দিয়ে নামবার কালে যেমন ঝাপটা কমে গিয়ে কেবল শুদ্ধিটুকু নিয়ে নামে, তেমনি জীবনে যেন যুক্তি তর্ক সব ভাসিয়ে দিয়ে কোমল ভালবাসার স্রোতে ভাসছি।
: বন্যা!
এল। আমি লাল চোখে তাকালাম,
: তুমি কে?
: এ কি পাগলের মতন কথা! আমি তো আমিই। আমাকে চেনো না বুঝি! গাধা!

বলে সে চলল। রান্নাঘর থেকে তেল পেঁয়াজের ঝালালো বাতাস আসছে। আমি মনে মনে বললাম, তুমি সত্যি নও!

___________________________

# দিনেকের দেখা, তিলেকের সুখ,
ক্ষণেকের তরে শুধু হাসিমুখ-
পলকের পরে থাকে বুক ভ’রে চিরজনমের বেদনা।
– রবী ঠাকুর

মানুষ ভাবে কি আর হয় কি! কোথায় ভেবেছিলাম ডায়রী লেখার ছল করে দুটো কথা বলব প্রাণভরে। ডায়রীর তো সাহিত্য হয়ে ওঠবার কোন দায় নেই, অথচ কথা সহজেই জমা পড়তে থাকে নিখাদ বোবা কথামালা।
.
কথা বলাটা যেন অনুবাদ সাহিত্যের মত। মেয়েটির মনের কথা মুখে বলতে বলতেই যেন রুশ ভাষা থেকে অনুবাদ হয় ইংরেজিতে, সে কথাই আবার ছেলেটার মগজে ঢুকতে ঢুকতে হয়ে ওঠে বাংলা। আর গুণিজনে বলেন, অনুবাদে সাহিত্যের রস অনেকটাই নাকি চলে যায়। ভেবে দেখুন তো, আপনার প্রেমের শ্রেষ্ঠ সময়… মুহূর্তগুলোর কথা। ওই মানুষটার ভালবাসি বলা কিংবা ঠাট্টা করে পিঠে চাপড় কিংবা খাইয়ে দেয়াও নয়, একগুচ্ছ নীরবতা। ওই নীরব মুহূর্তগুলোতেই আপনি ও সে দুজনেই অনুভব করেন সেই চরমতম সত্যটি যা কোনকালেই কারো সাধ্যে নেই কোন বাক্যে প্রকাশ করবার। যে হতভাগ্য একবার সে নীরবতা জেনেছে তার আর কোনকালেই বেঁচে থাকবার দ্বিতীয় কোন কারণ তৈরীই হয় না। যদি বলে তেমন, তবে মিথ্যে কথা বলে। কেউ জেনে, বেশিরভাগই না জেনে।
.
বিরক্ত হচ্ছেন, না? হবারই কথা। এই দশটা পাঁচটার জীবনে আমি আচমকা এমন সব কথা পেড়ে ফেলছি যেসব কিনা মোটেও লাভজনক নয়। ঈশ্বর ভক্ত কোন ছোট ছেলের মাথায় হুট করে যদি মহাপাপ চিন্তা এসে পড়ে তখন সে যেমন তাড়াতাড়ি মাথা নেড়ে উঠে পড়ে, চিন্তার ওমুখো হতে চায় না, ওপথে ভয়, ওপথে কষ্ট আর তীব্র কাঁটা দাগ… তেমন করেই হয়তো আপনি বছরদশেক আগের কোন স্মৃতিটাকে ঢাকা দিয়ে উঠে পড়ছেন। সে আপনি পারেন ষোল আনাই। আমি যে নিরুপায়!
.
সেই সন্ধ্যেয় আমার কিছু একটা হয়েছিল। মনে নেই। আমি জ্ঞান হলে দেখি হাসপাতালের কেবিন। যে নার্সটা চেয়ে আছে তার মুখ কোনমতেই বন্যার মতন নয়। বন্যাকে আমি দেখিওনি আর কোনওদিন। মনোবিদেরা হয়তো বন্যার উল্লেখে কঠিন কোন সাইকোলজিক্যাল ডিজঅর্ডারের কথা বলবেন, আমি ওকে ওর মতনই রাখতে চাই। থাকুক না! সে সত্যি না হোক, তার সাথে কাটানো প্রতিটা মুহূর্তই যে আমার কাছে সত্যতর? শংকরাচর্য নাকি বলেন, কেবল ব্রক্ষা সত্যি, জগৎ মায়া। তবে আর বন্যার কী দোষ? সে যেমন মায়া, তেমনি আমিও তো! তাতে আমার দুঃখ নেই তিলও। বুক জুড়ে ব্যথা বাজে কেবলই ওকে আর না দেখবার। বাবা আসে, কোন কোন আত্মীয় এসে দেখে যায়।
.
একা ছিলাম। বন্যার মত দেখতে নয় নার্সটা এসে বললেন, “আচ্ছা, উনি কই? কখনও এলেন না তো।”
ধড়াস করে উঠল বুক, “কে?”
“কাঁদতে কাঁদতে আপনার এম্বুলেন্সের জন্যে ফোন করেছিল যে মেয়েটা? ওর কান্না থামাতেই তো বেশ বেগ পেতে হয়েছিল আমাদের!”

// Tahsin Rifat Noor Rufty