বাংলা সিনেমা ভক্ত

4166
0

আমার ক্লাস নাইনের ছাত্র বাংলা সিনেমার বিশাল ভক্ত।আমি ওকে পড়াতে গেলে ও আমার সামনে বসেই হঠাৎ হঠাৎ করে চেঁচিয়ে সিনেমাটিক ডায়ালগ বলা শুরু করে।তাও কোনো সাধারণ ডায়ালগ না।একেবারে ডিপজল ভার্সনের ভাষা।আমি কয়েকবার ধমক দিয়ে বলি-
-পড়ালেখা শিখো এরপর সিনেমার ভিলেন হয়ো।
সে চেঁচিয়ে বলে-
-ম্যাডাম আমি,গরীব হতে পারি কিন্তু আমার অন্তরে একটা ভালো মনও আছে।
-পড়ায় মন না বসালে তোমার আম্মুর কাছে বিচার দিবো।
-ম্যাডাম,আমার মন বসে না পড়ার টেবিলে।
-সারাক্ষণ সিনেমা দেখলে বড় হলে তো কিছুই হতে পারবে না।
-বড় হয়ে আমি নায়ক জসিমের মতো সি এন জি চালক হবো ম্যাডাম।সি এন জি চালিয়ে কোটিপতি হয়ে যাবো।একদিন আপনি আমার মাথায় হাত রেখে বলবেন আজ যদি তোর প্রতিভাগুলো বেঁচে থাকতো…!
-থামো।আর একটা কথা না।পড়ালেখা কিছুই তো পারো না।
-ম্যাডাম,আমি সব পারি কিন্তু ডিম পারতে পারি না।

আমি ওর এইসব কথাবার্তা শুনে চুপ হয়ে থাকি।ওর মায়ের সাথে এই ব্যাপারে আলাপও করেছি।ছেলেটার মাও ওকে সামাল দিতে পারে না।ছোট থেকেই নাকি টিভির বাংলা সিনেমা দেখে দেখে বড় হয়েছে যার প্রভাব সে এখন ফেলছে।ওকে এর থেকে উদ্ধার করে আনাটা জরুরি কিন্তু কিভাবে যে করবো সেটাই গুছিয়ে উঠতে পারি না।যদি বলি-
-অন্তু,তুমি কথায় কথায় সিনেমার ডায়ালগ বলা পুরোপুরি ছেড়ে দিলে তোমার জন্য একটি পুরস্কারের ব্যবস্থা করবো।
এইবার অন্তু বিজ্ঞের মতো করে সিনেমাটিক স্টাইল ব্যবহার করে জবাব দিলো-
-না ম্যাডাম।না।এ হতে পারে না।আপনি আমার কাছ থেকে আমার প্রাণপ্রিয় জিনিস বলা কখনোই নিষিদ্ধ করতে পারবেন না।এই আমি কখনো হতে দিবো না।কখনো না।
আমার পরতে হলো মুশকিলে।এই ছাত্রকে নিয়ে তো দেখছি বিপদ।বড় হলেও কি এই ছেলের সিনেমার ডায়ালগ বলার অভ্যাস রয়ে যাবে কিনা কে জানে!
আমি একবার অন্তুকে বললাম-
-বড় হয়ে তুমি কি হতে চাও?
সে জবান দিলো-
-বলবো না ম্যাডাম।বললে আপনি রাগ করবেন।
-রাগ করবো কেন!বলো।
-ম্যাডাম,বড় হয়ে আমি ভিলেন হতে চাই।
সত্যি সত্যিই আমার রাগ হলো।ছেলেটা পাগল হয়ে যাচ্ছে সিনেমা দেখে।আমি বললাম-
-ভিলেন কেন হতে চাও!মানুষ তো ডাক্তার,ইঞ্জিনিয়ার বা পাইলট হওয়ার স্বপ্ন দেখে।তোমার কি ওসব হতে ইচ্ছে করে না!
-উহু।ওইগুলো সাধারণ জিনিস।আমি সাধারণ হবো কেন!আমি হবো অসাধারণ।
-তোমার কি ধারণা ভিলেন হওয়া অসাধারণ কিছু!
-হু।আমি সিনেমায় দেখেছি ভিলেনরা যা ইচ্ছে তাই করতে পারে।শুধু মারপিট জানতে হয়।আর কিছু লাগে না।আমি ঘুসি দেয়ার কায়দা শিখেছি টিভি দেখে।
-এই জন্যই কি তুমি ভিলেন হতে চাচ্ছ?
-হ্যা।
-সিনেমার শেষে কিন্তু ভিলেন হেরে যায় আর নায়ক জিতে যায়।তুমি কি শেষমেশ হেরে যেতে চাও অন্তু!
-ম্যাডাম,আমি বাংলা সিনেমায় দেখেছি নায়করা বড় হয়ে ফুচকা বিক্রি করে,বড়লোকদের গাড়ির ড্রাইভার হয়,কাজের লোক হয়।কিন্তু আমি বড় হয়ে তো ওসব করতে চাই না।সিনেমার নায়করা যদি বড় হয়ে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হতো তাহলে আমি সিনেমার নায়ক হতে চাইতাম।আর আপনাকেও খুশি করতে পারতাম।
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললাম-
-অনেক কথা শিখেছো।এইবার বই পড়ায় মনোযোগ দেও।

অন্তুর স্কুলে ওর বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্ট বের হলো।পরীক্ষায় সব বিষয়ে মোটামুটি ভালো রেজাল্ট করলেও বাংলা আর ইংরেজিতে তেমন একটা ভালো নম্বর এলো না।স্কুলে গিয়ে ওর স্কুল টিচারের কাছে অনুরোধ করে ওই দুটো বিষয়ের খাতা দেখে এলাম।ইংরেজি ডায়ালগ লিখতে বলা হয়েছিলো।আর সে লিখেছে “মারবো এখানে,লাশ পরবে শ্বশানে।” আর বাংলা ভাব সম্প্রসারণ আর রচনায় একেবারে নাজেহাল অবস্থা করে দিয়েছে এই ছেলে।বাংলা ‘আমার প্রিয় মানুষ’ রচনা লিখতে গিয়ে চিত্রনায়িকা সাবানাকে তার ভালো লাগে বলে প্রিয় মানুষ রচনা সে তাকে নিয়েই লিখেছে এবং এর সাথে সাবানার জীবন সংসারের পুরো হুবুহু কাহিনী রচনা মূল বিষয়বস্তুতে উল্লেখ করেছে।স্কুল টিচার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন-
-আপনি কি ওই ছেলের প্রাইভেট টিউশন টিচার?
আমি বললাম-
-জী,স্যার।
-আপনার ধৈর্য্যর তারিফ করতে হবে।এই ছেলেকে আপনি কি করে পড়ান!
আমি বললাম-
-ও আমার থেকে পড়ালেখা শিখে আর আমি ওর থেকে বাংলা সিনেমা শিখি।
আমি দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে চলে আসলাম।সেদিন অন্তুকে পড়াতে গিয়ে বললাম-
-এখন থেকে,ভালো মতো পড়বে।বুঝেছো!
অন্তু কোনো কথা বললো না।আমি বললাম-
-কি হলো!প্রমিজ করো তুমি এখন থেকে মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করবে।
অন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে বললো-
-বলবো কথা বাসর ঘরে।তাই মন বসেনা পড়ার টেবিলে।

লেখাঃ Polok Hossain