নিতুর সঙ্গে হাজার রাত্রি

4880
0

আপনার পাশে একটু বসি? মেয়েলি কন্ঠে মধ্য রাতে এমন প্রশ্ন শুনেও প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে নাসিম তার বা হাতে রাখা গোল্ডলিফ সিগারেটে শেষ টানটা চোখ বুজে দেয়, নিকোটিনের ধোয়া আত্নার মাঝে মিশিয়ে নেয় নাসিম । আচ্ছা বসলাম এই বলেই ভেজা বালুর উপরে ধপাস করে বসে পড়ে মেয়েটা । মেয়েটা আহামরি সুন্দরী না । গাঢ় কাজল, লাল টিপ আর আজকের অমিতব্যয়ী জ্যোৎস্নার আলো তাকে বেশ সুন্দর করে তুলেছে । সামনে বিশাল সমুদ্র আর পিছনে ঝাউবন । চাঁদটা ঠিক মাথার ওপরে এসে ঠেকেছে, সমুদ্রের বড় ঢেউগুলো ক্লান্ত হয়ে দুজনের পা ভিজিয়ে দিচ্ছে । সন্ধ্যার পর থেকে নাসিমের পেটে কিছু পড়েনি, মেয়েটার কাধে বড়সড় ব্যাগ দেখা যাচ্ছে হয়তো এক বোতল মিনারেল ওয়াটার পাওয়া যেতো পারে এই ভেবে নাসিম সিগারেটের ফিল্টারটা সমুদ্রের ঢেউয়ে ছুঁড়ে মেরে মেয়েটার দিকে না তাকিয়েই বলে “পানি আছে সাথে”? মেয়েটা কোন উত্তর না দিয়েই ব্যাগ থেকে আধা বোতল পানি আর একটা কেক বের করে দেয় । নাসিম এবার তাকালো মেয়েটার দিকে, মেয়েটা পানসে দৃষ্টিতে নাসিমের দিকে চেয়ে আছে । নাসিম বড়সড় ধাক্কা খায়, কেননা মেয়েটাকে সে বলেনি তার খুব খিদে পেয়েছে পানির সাথে অন্য কিছু থাকলেও যেন দেয় ।

কেকে কামড় বসাতে গিয়ে মনে হল মেয়েটার নামটা জেনেই কেকে কামড় দেয়া ভাল পাছে স্বার্থপর ভেবে বসতে পারে । কেকটা মুখ থেকে নামিয়ে মেয়েটার দিকে শান্ত চাহনি দিয়ে নাসিম মেয়েটার নাম জিজ্ঞেস করে, মেয়েটা ফিক করেই হেসে দেয় । নাসিম কপাল কুচকে মেয়েটার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল “হাসির মত কিছু বলেছি কী”? । মেয়েটা হাসি না থামিয়েই বলল” না হাসির কিছু বলেননি, আমি কারণ ছাড়াই হাসি কিছু মনে করবেন না”৷ আমি নিতু, আপনি? নাসিম পুরো কেকটা মুখের ভেতর পুরে দিয়েছে, কেকটা চাবাতে চাবাতে বলল” আমি নাসিম” । মেয়েটা আবার হাসি শুরু করল । নাসিম এবার আর বিরক্ত হল না, কয়েক ঢোকে পুরো পানি শেষ করে ফেলল । পকেটে থাকা শেষ সিগারেটটা জ্বালিয়ে টানতে শুরু করল নাসিম । নিতুর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল- এত রাত্রে এইখানে কী? নিতু এক নিশ্বাসে বলে -কাস্টমার রুম থেকে বের করে দিয়েছে, আজকের কাস্টমারটা ছিল মধ্যবয়স্ক । ব্যাটার কী যেন মনে হল সে আমার হাতে টাকা দিয়ে বলল রুম থেকে বেরিয়ে যেতে, কী আর করা বেরিয়ে আসলাম । চাইলে অন্য কোন রুমে থেকে যেতে পারতাম, কেন যেন খুব ইচ্ছে হল আজকের রাতটা সমুদ্রের পাশে বসে কাটায় । এই শ্রেণীর মেয়েদের কল গার্ল, বেশ্যা, পতিতা যখন যেটা বলতে ইচ্ছে করে সেটাই বলা যায় । নাসিম ঠিক করেছে মেয়েটাকে শুধুই নিতু বলে ডাকবে মেয়েটা শুদ্ধ বাংলায় কথা বলে, বাড়ি কোন অঞ্চলে সেটা বোঝার অবকাশ নেই, এতগুলো কথা বলল কিন্তু কোথাও আঞ্চলিকতার টান নেই ।

নাসিম নিতুর দিকে আধা খাওয়া সিগারেটটা এগিয়ে দেয়, নিতু বিস্মিত হয়! কেননা এই মুহুর্তে তার সিগারেট ফুঁকতে ইচ্ছে করছে খুব । জ্যোৎস্নার চাদর বিছিয়ে দেয়া এই পৃথিবীতে দুটো মানুষ অতি তুচ্ছ ব্যাপার দিয়ে একে অপরকে অবাক করে যাচ্ছে ! এই অবাক হওয়া মুহুর্তগুলো মানুষের কৌতূহল বাড়িয়ে দেয় বলেই পৃথিবীর মায়া ছাড়ানো এতটা কষ্টের । নিতু হা করে ধোয়াগুলো আকাশের দিকে ছাঁড়তে ছাঁড়তে বলে-আচ্ছা আপনি এত রাতে এখানে কেন? আপনার ভয় করছে না? নাসিম কখনো সামনে থেকে কোন মেয়েকে সিগারেট ফুঁকতে দেখেনি বলেই অনেকটা মুগ্ধ হয়ে নিতুর সিগারেট টানার দৃশ্যটা পলকহীন হয়ে দেখছে, নিতুর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে রোবট কন্ঠে নিতুকে বলল- আপনার ভয় করছেনা? নিতু এবার উচ্চ শব্দে হাসতে শুরু করল, একটা সময়পর হাসি থামিয়ে নাসিমের মুখের দিকে খানিকটা ঝুকে এসে চিকন গলায় বলল- বেশ্যার কাছে দিন ও যা রাত ও তা । ভয় পাবো কেন! আছেই বা কী আর যাবেই বা কী ! ।

আচ্ছা নিতু আসেন আমরা ইচ্ছা-ইচ্ছা খেলা খেলি । নিতু সিগারেটের ফিল্টারটা বালুর মাঝে রেখে দিয়ে নাসিমের দিকে তাকিয়ে বলে-এটা আবার কেমন খেলা? নাসিম দ্রুত গলায় বলে: ইচ্ছা -ইচ্ছা খেলা মানে এখন আপনি আমাকে বলবেন এই মুহুর্তে আপনার কী করতে ইচ্ছে করছে বা আপনার বিশেষ কোন ইচ্ছের কথা আমাকে বলবেন আর আমি আমারটা বলবো । নাসিম নামের মানুষটার প্রতি হুট করেই সম্মান বেড়ে যায় নিতুর, আজ অবধি কোন পুরুষ তাকে জিজ্ঞেস করেনি তার স্বপ্ন কী, তার ভাল লাগা কী । সবগুলো পুরুষ ই জানোয়ারের মত ছিঁড়ে খেয়েছে তাকে । নাসিমের চোখের দিকে শুভ্র চাহনী দিয়ে এক নিশ্বাসে নিতু বলল- আমার এই মুহুর্তে খুব ইচ্ছে করছে কোন একজনের কাঁধে মাথাটা রাখি, সে আমার উড়তে থাকা খোলা চুলে বিলি কেটে দিক, আমার কপালে আলতো করে তার ঠোঁট ছুঁয়ে দিক কিন্তু সে কপাল আমার নেই । মাগীদের কপালে এসব শখ আহ্লাদ, ভালবাসা থাকেনা যে । নিতুর চোখের পানি টলমল করছে, যখনতখন পড়ে যেতে পারে । নাসিম নিতুর মাথাটা তার কাঁধে রাখে, নিতুর মুখটা হা হয়ে আছে ! নিতু বাচ্চাদের মত গুটিসুটি হয়ে তার মাথাটা নাসিমের কাঁধে এলিয়ে দেয় । নিতুর চুলে বিলি কাটতে কাটতে নাসিম বলে – জানেন নিতু ঠিক এমন একটা ইচ্ছে ছিল আমার, মারিয়ার সাথে সারা রাত জেগে সমুদ্র বিলাস করব । মারিয়া তার মাথাটা আমার কাধে রাখবে আমি তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিব । জ্যোৎস্নার আলোয় সারা রাত জেগে তার ঘুমন্ত মুখটা দেখব । নিতু স্বার্থপরের মত নাসিমের বাহুটা জাপ্টে ধরে, নাসিমের দুঃখ শুনতে একদম ইচ্ছে করছেনা, তার ইচ্ছে করছে সারাটা রাত নাসিমকে জাপ্টে ধরেই রাতটা পার করে দিতে । নাসিম সযত্নে নিজেকে নিতুর কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সমুদ্রের ঢেউগুলোর কাছে যেয়ে দাঁড়ায় । নিতু নাসিমের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে । নাসিম কিচ্ছুক্ষণ পর আবার ফিরে আসে ।

রাত তিনটে বাজে এখন, চলুন হাটা শুরু করি তাহলে কাউয়্যারচরের দিকে যেয়ে সূর্যদোয় দেখতে পারব । ভোরে সূর্যের আলোয় সমুদ্রের লাল কাকড়াগুলোর দৌড়াদৌড়ি দেখতে পাবো । নিতু বাধ্য মেয়ের মত নাসিমের সাথে হাটা শুরু করে । আচ্ছা নাসিম সাহেব আপনার মারিয়া এখন নেই? না নেই । আমার এক বন্ধুর সাথে গোপন সম্পর্ক আছে তার, সেই বন্ধুকেই নাকি বিয়ে করবে । এইটা হল দুনিয়া, এক আজব জায়গা । যতসব উল্টাপাল্টা আউলাঝাউলা নিয়ম পাবেন এখানে । এক মেয়ে ভালবাসা না পেয়ে বেশ্যামি করে আরেক মেয়ে ভালবাসা পেয়ে বেশ্যামি করে, হা হা হা হা। নিতুর হাসিটা খুব বিশ্রী শোনাচ্ছে এই মুহুর্তে, নিতু আপনি বিশ্রীভাবে হাসবেন না প্লিজ । নিতু নাসিমের এমন অভিযোগে মুখ চেপে হাসছে, নাসিম দেখেও না দেখার ভান করে ।

ভোর হয়ে এসেছে, কুয়াকাটায় মানুষ আসেই এই সূর্যোদয় দেখতে । অনেক মানুষের ভীড় এখানে, সদ্য জন্ম নেয়া সূর্যটার মায়ামাখা মিষ্টি আলো এসে নিতুর মুখের উপর এসে পড়েছে । শ্যাম বর্ণের নিতুকে বড্ড নিষ্পাপ দেখাচ্ছে, নিতুর কোমরসমান চুলগুলো ফিরফিরে বাতাসে হেলেদুলে নেচে চলেছে । লাল কাঁকড়াগুলো দুজনের পায়ের উপর উঠে চলে আসছে । একটা বাইকে করে আদিবাসী পল্লীর দিকে চলে আসল । মাঝপথে হোটেল দেখে নিতু বাইক থামাতে বলে, ভূনা খিচুড়ি আর ডিম ভাজি খেয়ে নেয় । আদিবাসী মহিলার হাতে বানানো বিন্নি ধানের পিঠা খায় দুজন, একে অপরের কত জনমের চেনা যেন! একটা শাড়ির দোকানের সামনে এসে নাসিম নিতুকে নিয়ে দোকানে ঢুকে পড়ে, খয়েরি রঙের একখানা শাড়ি নিতুর হাতে তুলে দিয়ে বলে- এটা আপনার জন্য, মন খারাপের রাতে কপালে ছোট্ট একটা কালো টিপ, হাত ভর্তি চুড়ি আর এই খয়েরি রঙের শাড়িটা পরবেন দেখবেন মন ভাল হয়ে গেছে । আর হ্যা চোখের কাজল নেবার সময় একদম তাড়াহুড়ো করবেন না, খুব যত্ন নিয়ে কাজল দিবেন তাহলে এখনের মত কাজল লেপ্টে যাবেনা । নিতুর চোখ আবারো টলমল করছে, নাহ নিতুকে সুযোগ দেয়া যাবেনা একদম । নাসিম সিগারেটের কথা বলে নিতুর কাছ থেকে সরে আসে । এই চোখের পানি দেখলেই নাসিমের চোখ ভিজে আসে, কী দরকার এক অপরিচিতার কাছে নিজের চোখের পানি দেখাবার!

নাসিম নিতুকে না জানিয়েই অন্য একটা বাইকে করে চলে আসে বাস স্টান্ডে । বাস চলছে দ্রুত গতিতে, নিতুর ধরাছোয়ার বাইরে এখন নাসিম । নিতু তাকে পাগলের মত খুঁজে বেড়াবে, একটা সময়ে ক্লান্ত হয়ে খোঁজাখুঁজি বন্ধ করে দিবে । এই অপ্রাপ্তিই জীবনের বড় এক প্রাপ্তি হয়ে থাকবে দুটো ঠকে যাওয়া মানুষের জন্য । মন খারাপের রাতে নিতু খয়েরি রঙের শাড়ি পরবে, কপালের ঠিক মাঝখানটায় কালো রঙের ছোট টিপ পরবে খুব যত্নে কাজল নিবে । আবারো চোখের কাজল লেপ্টে যাবে, নিতু যে তখন আর টলমল করা জল আটকে রাখতে পারবেনা । কোন এক জ্যোৎস্নায় নিতুর দীর্ঘশ্বাস দীর্ঘতর হবে প্রাপ্তির অপ্রাপ্তিতে!

নিতুর সাথে একটা রাতে নাসিম যা পেয়েছে মারিয়ার সাথে তিনটে বছরের ভালবাসা বাসিতে তার ছিটেফোঁটাও নাসিম পায়নি । শুদ্ধ আবেগের বিপরীতে যখন প্রতারণা আসে তখন দুনিয়াটাকে বিষাক্ত এক উদ্ভট গ্রহ মনে হয়, যেখানে দম নেবার মত হাওয়া থাকেনা । নিতুরা ভালবাসতে শেখায়, নিতুরা ভালবাসে বলেই মারিয়াদের পাপমোচন হয় । নিতুর ইচ্ছেটা অল্পস্বল্প হলেও পূরন করেছে নাসিম, এই মেয়েটা আমৃত্যু এই ভালবাসার জন্য কাঙাল হয়ে এ বুকে ও বুকে ঘুরে বেড়াবে, নাসিম একটা জায়গায়া চুপটি মেরে বসে থাকবে হয়তোবা এক চিমটি ভালবাসার জন্য হন্যে হয়ে এ দুয়ার ও দুয়ার ঘুরবে আফসোস ভালবাসা এবার ও মিলবেনা । জগতের এক পৈশাচিক নিয়ম হল যারা ভালবাসার কাঙাল তাদের কপালে ভালবাসা জোটেনা । নিতুকে সেদিন না করার সাহস নাসিমের হয়নি, নাসিম জানে ঐ সামান্য ইচ্ছে, স্বপ্নের মূল্য কতখানি ।

আজও জ্যোৎস্না তার চাদর বিছিয়ে রেখেছে, সমুদ্রের ঢেউয়ের গর্জনে চারদিকটা মাতাল হয়ে আছে । আজও বড্ড খিদে পেয়েছে তার, চারটে বছর আগের ঠিক এমন রাতে একজোড়া নিষ্পাপ চোখ দেখেছিল নাসিম, ভালবাসার এক কাঙালিনীকে পায়ে ঠেলার তীব্র যন্ত্রণা বুকের ভেতরের নরম জায়াগাটা এভাবেই ফালাফালা করে দিচ্ছে আজও ।

লেখাঃ Borhan Uddin