“হ্যালো?”
“কেমন আছো?”
“কে বলছেন প্লিজ?”
“এতো তাড়াতাড়ি আমার গলা ভুলে গেলে? মাত্রই তো তিনমাস হয়েছে? নাকি অভিমান বেশি হয়েছে বলে না চেনার ভান করছো?”
এপাশটা কিছুক্ষণ নিরব। তার নিশ্বাস এর শব্দও পাওয়া যাচ্ছে না। ওপাশ থেকে উদ্বিগ্ন কন্ঠস্বর-
“তুমি কাঁদছো না তো পুতুল? আমি সত্যিই সরি! এবার একমাস বেশি থাকতে হলো যে, আমি কি করবো বলোতো? আমার বুঝি ভালো লাগে তোমার থেকে দূরে থাকতে?”
ওপাশে পুতুল নামের অভিমানি মেয়েটা ফোঁস করে ওঠে রাগে।
“আপনার তো ভালোই লাগে! জাহাজে সমুদ্রে ভাসতে পচ্ছন্দ না আপনার?”
ফোনের ওপাশের মানুষটা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়েন। আজকাল নোনা জল যে তাকে শান্তি দেয় না আগের মতো একথা এই মেয়েকে কে বোঝাবে? কে বোঝাবে মেয়েকে যে, এক বন্দর থেকে আরেক বন্দর যেতে যে গভীর সমুদ্র পাড়ি দেয় নাবিক তার মাঝে শুধু পুতুল নামক পরীটাকেই দেখে। না না দেখে না শুধু কল্পনা করে। ওকে তো দেখেনি কখনো সামনা সামনি! তবুও যেন অন্তরের অনেকটা জুরে আছে পুতুল!
“এখন কি ফোনে কথা বলতে বলতে সমুদ্রে হারিয়ে গেলেন নাবিক সাহেব?”
পুতুল রাগান্বিত হয়ে কথা বলে।
“একটু সুন্দর করে আমার নামটা বলো না পুতুল! অনেকদিন তোমার রিনরিনে গলায় আমার নামটা শুনি না।”
“এহহহ, আমার বয়েই গেছে ওনাকে ডাকতে! ”
“প্লিজ, সোনা। একবার ডাকো না, খুব ইচ্ছে করছে শুনতে!”
ওপাশের কাতর কন্ঠ শুনে একটু নরম হয় পুতুল। যেন মোমের মতো গলে গেলো, খুব আদুরে গলায় মিষ্টি করে ডাকলো-
“রিজু, আমি খুব রাগ করেছি। কেন তুমি এতো লেইট করলে বলো তো? পুরো একটা মাস আমি তোমার ফোনের অপেক্ষায় কাটিয়েছি। কোনো কাজে মন বসে না। ফাস্ট ইয়ারের এক্সামে তো ডাব্বা মেরেছি। সব দোষ কিন্তু তোমার?”
ওপাশে থাকা রিজওয়ান ওরফে রিজু হেসে দেয়। পাগলি মেয়ে একটা। কতো সহজে রাগ গলে পানি হয়ে গেলো।
“আচ্ছা, সব দোষ আমার। এবার কি তবে আমাদের দেখা হতে পারে? ফোনে ফোনে আর কতোদিন বলোতো?”
“তুমি এবার কতোদিনের ছুটিতে এসেছো,তা আগে বলো?”
“একমাস তো আছি, তুমি বললে ছুটি বাড়িয়ে নিবো। বিয়ের প্রস্তাব দেই বাসায়? ”
“না না, এখনই না,প্লিজ! অন্তত ইন্টারটা পাশ করতে দাও? তারপর না হয় প্রস্তাব দিয়ো?”
“পুতুল, আজকাল আমার একটু বেশিই কষ্ট হয় জানো তো? কতদিন পরে পরে দেশে আসি। তারপর কি এই একটু কথায় মন ভরে! প্লিজ চলোনা দেখা করি?”
রিজু অনুনয় করে। পুতুল অনেকক্ষন চুপ থাকে। “আচ্ছা, ঠিক আছে। দেখা করবো তবে আমার একটা শর্ত আছে। ”
“কি শর্ত?”
“তোমায় সেদিন পান্জাবী পড়তে হবে নাবিক। রাজি আছো?”
“বাস, এতটুকু? তোমার জন্য তো আমি সমুদ্র বিজয় করে আসি। এ আর এমন কি?”
“আচ্ছা! তবে তুমি ধুসর গোধুলি রঙের পান্জাবী পড়বে।”
“এ আবার কি রং? কখনো দেখিনি তো?
” তবে দেখে নিও নাবিক। আমি তোমায় প্রথম দেখায় এভাবেই দেখতে চাই। বুঝলে?”
“যদি না পাই?”
“তবে আর দেখা হবে না।”
“প্লিজ এতো নিষ্ঠুর হয়ো না! আমার বড্ড ইচ্ছে হচ্ছে তোমায় দেখার।”
“আমার কিছু স্বপ্ন আছে, জানো? তারমধ্যে একটা আমি বারবার দেখি।”
“কি?”
“কোনো এক গোধুলি বিকেলে গভীর সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে জাহাজের ডেকে তোমার সাথে দাঁড়িয়ে থেকে সুর্যাস্ত দেখবো। সূর্যটা লাল হয়ে সমুদ্রের পানিতে যখন তলিয়ে যেতে থাকবে তখন আকাশে ঘন মেঘের আনাগোনা হবে। সূর্যকে ঘিরে ফেলবে ঘন কালো মেঘ, দেখতে কেমন লাগবে বলো তো নাবিক?”
রিজুর এসব শুনে যেন আরো একবার সমুদ্রে ভাসতে ইচ্ছে করে! মনেমনে ভাবে, জাহাজে শুধু ও আর পুতুল থাকলে বেশ মজা হবে। রিজুর কল্পনায় পুতুলের স্বপ্ন ডালপালা গজায়। স্বপ্নে বিভোর রিজু অকারনে হেসে ওঠে।
“কি হলো নাবিক? গভীর ভাবনায় নিমজ্জিত নাকি? ”
পুতুলের কথায় ধ্যান ভাঙে রিজুর।
“তবে,আমাদের দেখা হচ্ছে তো?”
“যদি শর্ত পূরন হয় তবেই হবে। তা না হলে আমায় কিন্তু দোষ দিয়ো না নাবিক! ”
রিজু হেসে ফোন নামিয়ে রাখে।
রিজুর মনে পরে পুতুলের সাথে প্রথম কথা বলার মুহুর্তটি। এই তো বছর দুয়েক আগে প্রথমবার সমুদ্র থেকে এসে বাসায় অলস সময় কাটাচ্ছিলো রিজু। হঠাৎই একদিন এলোমেলো একটু নাম্বার মিলিয়ে ডায়াল করে ফেললো, ওপাশে পুতুলের রিনরিনে কন্ঠস্বর শুনে থমকে গেছিলো রিজু। পুতুল তখন ক্লাস টেনে পড়ে। দু চারটে কথা বলে ফোন রেখেই দিচ্ছিলো রিজু। ওপাশ থেকে পুতুল বলে-
“একটু কথা বলুন না ভাইয়া। জানেন, আজ আমার মন ভীষণ খারাপ! আমার এক ফ্রেন্ডের সাথে খুব ঝগড়া হয়েছে। ওর সাথে কাট্টি নিয়েছি। আমার সেই ছোট বেলার বন্ধু ও। আর আমি কিনা ওর সাথেই ঝগড়া করলাম? মনটা খুব খারাপ লাগছে, জানেন?”
পুতুলের সহজ সরল কথা শুনে বেশ হেসেছিল রিজু। তারপর প্রায়ই কথা হতো পুতুলের সাথে। এরপর আবার একদিন সমুদ্রের ডাক আসলো, আর রিজু ভেসে বেড়ালো সমুদ্রে। তাড়াহুড়োয় বলে আসা হয়নি পুতুলকে। তিন চার মাস পরে স্থলে পৌঁছে ফোন করেছিলো পুতুলকে। প্রথম কয়েকদিন রাগ করে কথাই বলেনি পুতুল। তারপরে একদিন ওর রাগ ভাঙলো। আবার কথা শুরু হলো। এভাবেই চলছে আজ তিন বছর। পুতুলকে বিয়ে করতে চায় রিজু,অথচ পুতুল বরাবরের মতোই এবারো না বলছে। এমনকি দেখা করতেও রাজি হয় না। রিজওয়ান মনে মনে অস্থির হয়। এবার যে করেই হোক পুতুলের সাথে দেখা করবেই ও।
দুইদিন পর আবার ফোন দেয় রিজু-
“হ্যালো, পুতুল! কবে দেখা করবে বলো তো?”
“ধুসর গোধূলি রঙের পান্জাবী পেয়েছো নাবিক?”
“হুম, পেয়েছি। তুমি বলো কবে দেখা করবে? ”
“কালই করি? আমারও তোমায় দেখতে ইচ্ছে করছে নাবিক?”
“ঠিক আছে! তবে কালই দেখা হোক? আমি চারুকলার সামনে দাড়াবো।”
“আচ্ছা। ”
“তুমি কিন্তু শাড়ী পরে এসো পুতুল। লাল টকটকে রঙের শাড়ি। বেশ পুতুল পুতুল লাগবে তোমায়।”
“আচ্ছা, ঠিক আছে। তোমার কথা মানবো। লাল শাড়ী পরেই আসবো যাও।”
চারুকলার সামনে অপেক্ষায় থাকা রিজু কেবল অস্থির হয়ে ঘড়ি দেখে। কত মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে, অথচ ও যার প্রতিক্ষা করছে সে আসে না। লাল শাড়ী পড়া কাউকে দেখলেই মনেহয় এই বুঝি পুতুল এলো! সন্ধ্যা পর্যন্ত ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলো রিজু। এরমাঝে কতশত বার পুতুলকে ফোন দিলো রিজু, কিন্তু ওপাশ থেকে সারা পেলো না। আরো খানিক বাদে ফোনটাই বন্ধ পেলো। ক্লান্ত বিদ্ধস্ত হয়ে রিজু বাসায় ফিরে আসে। প্রচন্ড অভিমানে আহত রিজু পুতুলকে আর কলও দিলো না। ঠিক রাত দশটার সময় পুতুলের ম্যাসেজ এলো-
” তুমি আমায় মিথ্যে বলেছো, নাবিক। ধুসর গোধুলি রঙের পান্জাবী তো তুমি পড়োনি? তাই আর তোমার সাথে দেখা করলাম না। তুমি বড্ড খারাপ মানুষ, নাবিক! আর কখনো কথা হবে না আমাদের। ফোন দিয়ো না কখনো!”
রিজু ম্যাসেজ পড়ে বসে থাকে ঠায়। পুতুল কি তবে এসেছিলো? ওকে দেখে ফেরত চলে গেছে?
এই পাগল মেয়েটাকে কি করে বোঝাবে যে, ঐ নামের কোনো রং হয় না। ওটা শুধু প্রকৃতির একটা খেলা। গোধূলির লালচে রঙের মাঝে যখন মেঘের মিলন হয় তখন কেমন একটা ধূসর রঙ হয়, এটা কি কাপড়ে তোলা যাবে? কেন যেন মনে হলো পুতুল বাহানা করলো। ওর সাথে দেখা না করার বাহানা। বড্ড অভিমান হলো রিজুর। ফোনটা বন্ধ করে দিলো রিজু। এই নাম্বার আর খুলবে না ও।
ওদিকে পুতুল বিছানায় শুয়ে শুয়ে বিসন্ন চোখে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে থাকে দিনের পর দিন। মনে মনে বলে, আমায় ক্ষমা করো নাবিক। আমি তো যাইনি তোমার সাথে দেখা করতে। আমার তো কোথাও একা যাওয়ার ক্ষমতা নেই। আমার যে পা নেই রিজু! এক্সিডেন্ট আমার পা কেড়ে নিয়েছে, রিজু। কিভাবে তোমার সামনে দাঁড়াবো নাবিক? তাইতো মিথ্যে অভিনয়! এই আমার পড়ালেখা, আমার কল্পনা সব মিথ্যে! সব! এরচেয়ে এই ভালো, তুমি অভিমান করে দূরে সরে গেলো। আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে রিজু। তোমার গলাটা আর শুনতে পাবো না। দুজনের আর কল্পনায় একসাথে সমুদ্রে ভাসা হবে না! তোমার ফোনের অপেক্ষা হবে না! প্রকৃতির নিষ্ঠুরতায় নিস্ফল আক্রোশে ফুঁসে ওঠে পুতুল। ও কাঁদে না, কেবল হাঁটুর নিচের অংশটুকু ফিল করার চেষ্টা করে।
পরের মাসে সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে রিজু উদাস নয়নে আকাশ পানে তাকিয়ে থাকে। জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে থুতনিতে হাত রেখে ডুবে যাওয়া সূর্য দেখতে দেখতে রিজু খেয়াল করে, লাল সূর্যের আশেপাশে কিছু ঘন মেঘের আনাগোনা। কেমন অদ্ভুত একটা পরিবেশ সৃষ্টি হলো। রিজু অবাক হয়ে ভাবে, এটাই কি তবে ধুসর গোধুলি? কি এক অপার্থিব সৌন্দর্য পুরো আকাশ জুড়ে! এই রং কেবল মনের ভেতর ধারন করা যায়। এতো নিঁখুত কল্পনা কিভাবে করলো পুতুল? ইস,যদি এখন পাশে থাকতো পুতুল? কি ভালোই না হতো? রিজু ভুলেই গেলো, সে পুতুলের সাথে অভিমান করেছে। তার কেবল মনেহলো পুতুল তার সাথে বসেই এই আশ্চর্য সৌন্দর্য উপভোগ করছে। রিজু নিবিষ্ট মনে প্রকৃতির এই অপার সৌন্দর্য নিজের মধ্যে ধারন করছে। যদি কখনো সুযোগ হয়, রংটা ছড়িয়ে দেবে পুতুলের মধ্যে। নাবিক তো আর জানে না, এটা প্রায় অসম্ভব একটা ভাবনা!
লেখাঃ Farhana_Yesmin