কাহিনী কখনো গল্পকেও হার মানায়

4968
0

আমার যখন বিয়ে হয়, তখন এই বিশাল পৃথিবীতে আমি আর বাবা প্রতিনিয়ত মনের সাথে যুদ্ধ করছিলাম আমাদের সাথে ঘটে যাওয়া বাস্তব পরিস্হিতির সংগে। কেননা ঘটনাগুলো খুব দ্রুততার সাথেই ঘটছিলো। যেমন, যে দাদীকে জন্মের পর থেকে আমাদের বাসায়ই দেখেছি সব সময় অর্থাৎ দাদীর আদর ভালোবাসায় বেড়ে উঠেছিলাম, সেই দাদী বার্ধক্যজনিত কারনে মারা গেলেন। ঠিক দু- তিন মাসের মাথায় হঠাৎই একদিন জানতে পারলাম আম্মার দুটো কিডনিই পঁচাশি পার্সেন্ট নষ্ট হয়ে গেছে, করণীয় আর কিছুই নেই। প্রতিদিন নিজের মায়ের মৃত্যুর প্রহর গুনাটা যে কতটা ভয়ংকর তা একমাত্র আমাদের মত পরিস্হিতির যারা শিকার তারাই কেবল বুঝবেন। একদিন সেই ভয়ংকর দিনটা এলো, যেদিন আম্মা আমাদের ছেড়ে চিরতরে চলে গেলো। আম্মার মৃত্যুর দুদিন আগে ছোট খালাম্মাও কিডনি ড্যামেজে মারা গেলো। মানে খালাম্মার কুলখানির দিন আম্মার মৃত্যু!
সংসারে আমরা ছিলাম চারজন। আমাদের কোনো ভাই ছিলো না। একটা মাত্র বোন ছিলো, তাকেও আম্মার মৃত্যুর এক বছরের মাথায় প্রবাসে পাড়ি দিতে হয়েছিলো সঙ্গত কারনে। ব্যাস, পুরো বাড়িতে আমরা দুজন বাপ আর মেয়ে!
সেই সময়ের কয়েক মাসেই আমি জীবন- জগৎ- সংসার সম্পর্কে যতকিছু জেনেছিলাম / বুঝতে শিখেছিলাম তা মানুষ বছরের পর বছরেও বুঝবে না। পরিস্হিতি মানুষকে অনেক কিছু শেখায়, অনেক কিছু জানায়, মানুষের অভিজ্ঞতার ঝুলি সমৃদ্ধ করে। যদিও তার বেশিরভাগই হয় বেদনার/ তিক্ততার। বেদনা আমাদের মনকে পুড়িয়ে হয়ত খাঁটি সোনা বানায়, নয়ত না! কি জানি কোনটা! তবে পৃথিবীর সব সত্যি মেনে নেওয়া যে কত কঠিন সেটা তখুনি আমি উপলব্ধি করেছিলাম।
পাঠক, আমি আজ আমার সে সময়ের মন খারাপের কাহিনী লিখবো না, লিখবো সেই পরিস্হিতি জয়ের কাহিনী ! ……

এরমধ্যে হঠাৎই আমার বিয়ে ঠিক হয়ে যায়। আত্নীয়- স্বজন, বাবা, সবাই চায়ছিলো আমি যেনো বিয়ে করে সংসারী হই। তাতে আমার আপত্তি ছিলো না। কিন্তু একটা সমাধানহীন সমস্যা আমাকে সব সময় অস্হির রাখতো। আমি বিয়ে করে চলে গেলে বাবাকে দেখার একজন মানুষও নেই। সবাই হয়ত বলবেন, বাবাকেও বিয়ে দিয়ে দেন। এটা বলা যতটা সহজ বাস্তবে প্রয়োগ এতটা সহজ ব্যাপার নয়। তাছাড়া, বিয়ে বললেই হয়ে যায় না। আনুষঙ্গিক অনেক কিছু মেলানোর ব্যাপারও আছে। তাছাড়া ইচ্ছা – অনিচ্ছা বলেও কথা আছে।…..
যাইহোক আমার গায়ে হলুদের দিন দুপুর বারোটার দিকে আমাদের বাসায় একটা ছেলে বাবুর্চি এলো- যে আমাদের পূর্ব পরিচিত। (এখানে বলে নিই, আমার বাবা কিছুই রান্না করতে পারেন না। কখনো দরকার পড়েনি অতীতে।) বিকেল চারটায় আমার গায়ে হলুদ। দুপুর দুটো পর্যন্ত আমি সেই বাবুর্চিকে বাসার সব জিনিসপত্র বুঝিয়ে দিলাম, কোথায় মাসিক বাজার থাকে, কোথায় কোন্ মশলা আছে – সবকিছু। আমার বরাবর অভ্যাস সব মশলার বোয়ামে মশলার নাম লিখে রাখা। তাই হয়ত হাতের নাগালে সবকিছু গোছানো ছিলো বলে বাবুর্চির দুঘন্টার মধ্যে সব বুঝে নিতে ঝামেলা হলো না। তাকে আরো বেশ কিছু সাংসারিক বিষয়ে বুঝিয়ে বললাম।
পাঠক হয়ত ভাবছেন, বিয়ে বাড়িতে আমি একা কেনো? দাদীর মৃত্যু, আম্মার মৃত্যু, বোনের বিদেশ যাওয়া – সবকিছু মিলে বাবা কিছুটা আপসেট ছিলেন, তাই আমার হলুদ, বিয়ের অনুষ্ঠান সব আমার বড় খালাম্মার বাসাতেই হয়েছে। আম্মারা তিন বোনের মধ্যে দুজন তো দুনিয়া থেকেই চলে গেলো, ছিলো বড় খালাম্মা। বড় খালাম্মা তখন আমার মায়ের ভূমিকা পালন করেছিলেন। অবশ্য এখানে আরো তিনজন মানুষের নাম না উল্লেখ করলেই নয়। তারা হলেন আমার বড় খালার ছেলে শাহীন ভাইয়া, তাঁর স্ত্রী লিপি ভাবী, খালাতো বোন লিলি আপা। কিছু মানুষের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই, তবে এই তিনজনের অন্যরকম ভালোবাসা আমাকে সব সময় ঘিরে ছিলো খুব শক্ত ভাবে ।……

যেটা বলছিলাম, হলুদ, বিয়ে সব কিছুই সুন্দর ভাবে শেষ হওয়ার পর যখন শ্বশুর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম (মগবাজার থেকে শ্যামলী) তখন মনে হলো বাবাকে ছেড়ে আমি হাজার মাইল দূরত্বে পাড়ি জমাচ্ছি। সে সময় মোবাইল ছিলো না। বাসার টি এন টি ফোনই ভরসা। সারাটা রাস্তা কেবল বাবার চেহারাটা ভাসছিলো চোখের সামনে। আমাদের সংগে ঘটে যাওয়া প্রতিটা ঘটনা আমি ভুলে যেতে চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু পারছিলাম না। কেবল অনুভব করছিলাম আমার বুকের ভেতর বুলডেজার দিয়ে সব ভাংচুর হচ্ছে – এ ভাংচুর কেবলি একজন মেয়ের তার অসহায় বাবার জন্য। কেবলি মনে হচ্ছিলো, একটু পরই বাবা বিয়ে বাড়ির হৈ- চৈ ফেলে নিঃসঙ্গ হয়ে ফিরে যাবে একাকী বাসায় — যেখানে এতদিন তার বেঁচে থাকার একটা মাত্র সঙ্গী আমি ছিলাম, আজ নেই! আমার ঘরে গিয়ে নিশ্চয় বাবা চুপচাপ বসে থাকবে আজ। আমাকে তো আজ কাঁদলে চলবে না। আজ আমাকে হাসি মুখে থাকতে হবে, কেননা আমি একটা অচেনা পরিবারে, অচেনা পরিবেশে যাচ্ছি। সেখানের জীবন অন্য রকম জীবন! …..
এক সময় শ্বশুরবাড়ি এসে পৌঁছালাম। আমার স্বামীর নয় ভাই- বোন। তিনজন দেশের বাইরে, বাকিরা ঢাকাতে। বিয়ে বাড়ি উপলক্ষ্যে দেশ- বিদেশ থেকে বেশ কিছু আত্নীয়- স্বজনও এসেছিলেন, যারজন্য বাসাভর্তি মানুষ, আনন্দ, হৈ চৈ – অন্যরকম এক পরিবেশ! আমি আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করেছিলাম, সারাটা রাস্তায় আমার যতটা অস্হিরতায় কেটেছিলো, শ্বশুরবাড়িতে প্রবেশ করার ঘন্টা খানেক পরই আমার প্রতি ওদের আন্তরিক ব্যবহারে সেই অস্হিরতা কেটে যাচ্ছিলো। ওরা সম্ভবত আমার আর বাবার একাকীত্বের জীবন কাহিনী জেনে আমার প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলো। সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা পরিবেশে এসেও আমার ভালো লাগতে শুরু করলো। দেওর, ননদ, ননাসের ব্যবহারে আমার মন থেকে সব ভয় দূর হয়ে গেলো। মনে হলো এতদিন আমি একা ছিলাম, আজ থেকে অনেকগুলো ভাই- বোন পেলাম।
রাতে বাবার সাথে ফোনে একটু কথা হলো। পৃথিবীর সব বাবাই চান, তার মেয়ে বিবাহিত জীবনে সুখী হোক, শান্তিতে থাকুক। হয়ত আমার কন্ঠস্বরে সেই স্বস্হি তখুনি বাবা পেয়ে গিয়েছিলেন।…..
আমার স্বামী সম্পর্কে এখানে কিছু বলা দরকার। আমার স্বামীর সহানুভূতি, মায়া, ভালোবাসা, দায়িত্ববোধ আমাকে একটা নতুন জীবন দিয়েছিলো। সে যখন আমাকে বিয়ে করে সে সময় আমি বিপর্যস্ত মনের একটা মেয়ে ছিলাম। মন খারাপ আমার নিত্যদিনের সঙ্গী ছিলো। আমি মাঝে মাঝেই আকুল হয়ে কাঁদতাম আমার মায়ের জন্য, আমার বোনের জন্য, আমার বাবার জন্য। এই কান্নাটা আমার মনের এত গভীরে চলে গিয়েছিলো যে, আমি স্বপ্নের মধ্যেও কখনো কখনো কাঁদতাম!! …. আমার সেই বিধ্বস্ত/ বিপর্যস্ত মানসিক অবস্হায় আমি পরম নির্ভরতার একটা হাত আমার মাথার উপর আমি অনুভব করতাম, সেই হাতটা ছিলো আমার স্বামীর ।…..
বিয়ের পর প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে আমরা দুজন আমার বাবার কাছে চলে যেতাম, শুক্রবার বিকেলে শ্বশুরবাড়ি ফিরে আসতাম। বাবা বারান্দায় বিকেল থেকেই দাঁড়িয়ে থাকতেন আমার অপেক্ষায়। শুক্রবার শ্বশুরবাড়ি ফিরেই আমি প্রথম ” মা- মা ” ডাকতে ডাকতে আমার শাশুড়ির রুমে ঢুকতাম, কিছুক্ষণ গল্প করার জন্য। নিজের মায়ের অভাবটা হয়ত শাশুড়িকে দিয়ে পূরণ করতে চায়তাম , কেননা মায়ের জন্য বুকভরা হাহাকার আমাকে সেই ভালোবাসা পাওয়ার জন্য কাঙ্গাল বানিয়ে রাখতো।
একদিন উনি ছোট ননদকে বললেন, তনু এসেই তো আমাকে খুঁজবে, ওকে বলিস না আমি কোথায় আছি, বলে উনি কিচেনের দরজার আড়ালে লুকিয়ে থাকলেন। আমিও স্বভাবসুলভ “মা- মা” ডাকতে ডাকতে উনার রুমে ঢুকে দেখি নেই। তখন কিচেনে উঁকি মেরে দেখি, সেখানেও নেই। কি ব্যাপার! দেখি দরজাটা নড়াচড়া করছে। ওখানে উঁকি দিতেই দেখি শাশুড়ি হাসি মুখে লুকিয়ে আছেন। ছোট ননদ তখন লুকিয়ে থাকার কারনটা জানালো।…..

এভাবে ছয়টা মাস কেটে যায়। বাবার বাসার বাবুর্চিটাও হঠাৎ চলে যায়। দেশে তার বউ বাচ্চার কাছে। জটিল পরিস্হিতির মুখোমুখি হতে হলো আমাদের। এই পরিস্হিতি কিছুটা বুঝলেন শ্বশুর – শাশুড়ি। মত দিলেন আমাদের বাবার বাড়ি গিয়ে থাকার জন্য। শাশুড়ি আমাকে বললেন, আল্লাহ আমাকে নয় জন সন্তান দিয়েছেন, তার থেকে একজন সন্তান না হয় আমি তোমার বাবাকে দিলাম। আলহামদুলিল্লাহ্।
শুরু হলো নতুন রুটিন। প্রতি শুক্রবার সকাল থেকে রাত দশটা পর্যন্ত শ্বশুর বাড়ি কাটাতাম। যতদিন শ্বশুর- শাশুড়ি বেঁচে ছিলেন। কখনো এটা নড়চড় হয়নি। শুক্রবার যে কোনো দাওয়াত, বেড়ানো, আত্নীয় স্বজনের বাসায় যাওয়া কিংবা তাদের আমাদের বাসায় আসা সবই বাদ দিয়েছিলাম সানন্দেই। কেননা ঐ দিনটা ছিলো কেবলি আমার শ্বশুর বাড়ির জন্য। তাছাড়া আমার স্বামীর ভাই- বোনদের মধ্যে খুবই মিল – যা এখোনো বর্তমান। তারা সবাই মিলে একটা জগৎ করে নিয়েছে – যে জগতে রয়েছে, একজনের প্রতি অন্য জনের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর সহানুভূতি। এমন একটা পরিবেশে থাকলে যে কারো মন ভালো হয়ে যাবে। এটা বর্তমান সমাজে বিরল। ব্যাপারটা যেমন সুন্দর তেমনি শিক্ষণীয়।…..
বহু বছর পার হয়ে গেছে। বাবা এখনো আমার সংগে থাকেন। তাঁর দোয়ার বরকতে আমার জীবন আজ সব দিক দিয়ে পরিপূর্ণ। আমি সব সময় চেয়েছিলাম, আমার বাবার কোনো ছেলে সন্তান নেই বলে কোনোদিন তার ভেতর থেকে যেনো কষ্টের দীর্ঘশ্বাস বের না হয়। আমি চেয়েছিলাম মেয়ে সন্তানের লেবাস টা উঠিয়ে সত্যিকার একজন সন্তানের দায়িত্ব পালন করতে। তবে এজন্য আমার স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির বিরাট ভূমিকা রয়েছে। জীবনের কিছু সীমাবদ্ধতা আন্তরিকতা / বুদ্ধি / চেষ্টা দিয়ে জয় করা যায়। আম্মা মৃত্যুর পনেরো দিন আগে আমাদের দু- বোনকে বলেছিলেন, আমি তো মা তোমাদের বিয়ে দেখে যেতে পারলাম না। তবে আমি দোয়া করছি, তোমরা জীবনে অনেক সুখে থাকবে।…..
আলহামদুলিল্লাহ, আমরা দু বোনই সুখে আছি।
মায়ের দোয়ার বরকতেই কিনা জানিনা, জীবনের ছোট – বড় সমস্যা গুলো কিভাবে যেনো পাশ কাটিয়ে চলে গেছে বরাবর। উঁচু- নিচু জীবনের পথটা মসৃন আর সুন্দর হয়ে গেছে। মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়ার অন্ত নেই আমার, সেই সংগে কৃতজ্ঞতা।

লেখাঃ ফেরদৌসী ইয়াসমীন তনু…