একটি হীরা এবং অভিশপ্ত জীবন

5519
0

অনেকের বিশ্বাস, এই মহামূল্যবান পাথরটি অভিশপ্ত। এর মালিকের নানা অমঙ্গলের কাহিনী লোকমুখে প্রচলিত। বলা হয় এই হিরকটি যখনই যার অধিকারে থেকেছে তাকেই একেরপর এক দুর্ঘটনা, দুর্বিপাকে পড়তে হয়েছে। জনশ্রুতি আছে, এই হিরকের মালিকরা অশান্তি, বিয়ে বিচ্ছেদ, আত্মহত্যা, কারাবরণ, নির্যাতন, আর্থিক ক্ষতি, বিনাবিচারে মৃত্যুদণ্ড অথবা শিরশ্চেদের শিকার হয়েছেন।

এমন ঘটনাও জানা যায়, এর এক মালিককে কুকুর কামড়ে খামছে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল। আরেক জন ফ্রান্সে বিক্ষুব্ধ জনতার হাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে নিহত হন।

হীরা! প্রকৃতির অন্যতম মহামূল্যবান এ পাথরের জন্য একসময় স্বজনের রক্ত ঝরাতেও কসুর করেনি মানুষ। লাখ লাখ ডলারে বিক্রি হওয়া এসব হীরা যে সব শ্রমিক খনি থেকে সংগ্রহ করে, বিনিময়ে তাদের ভাগ্যে জোটে নির্যাতন আর শোষন। কেউ নিজের আভিজাত্য প্রকাশ করতে, কেউবা প্রেমিকার মন ভজাতে আবার কেউবা জোতিষ্যির পরামর্শে ভাগ্য সুরক্ষায় মহামূল্যবান এই রত্ম ব্যবহার করে থাকেন। তবে অনেকের ক্ষেত্রে ভাগ্য সুরক্ষার পরিবর্তে রীতিমতো অভিশাপ হয়েই দেখা দিয়েছে এই হীরা।

ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের গোলকুন্ডার কল্লুর খনি থেকে এ হীরাটি উত্তোলিত হয়েছিল বলে জানা যায়। অনেকের ধারণা পরবর্তীতে হীরাটি রাজ্যে রামের স্ত্রী সীতার মন্দিরে রক্ষিত ছিল। কঠোর নজরদারি এড়িয়ে হীরাটি চুরি করেন এক দরিদ্র পুরোহিত। এক সময় সে ধরা পড়ে এবং তাকে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়। ষোড়শ শতকে ভারত ভ্রমনে আসেন ফরাসি ব্যবসায়ী ও পর্যটক জিন ব্যাপ্টিস্টি তাভারনির। ওই সময় হয় তিনি হীরাটি চুরি করেন অথবা কোনো চোরের কাছ থেকে কিনে নিয়েছিলেন। ১৬৬৯ সালে ফ্রান্সের সম্রাট চতুর্দশ লুই এটা তাভারনিরের কাছ থেকে কিনে নেন । পরবর্তীতে হীরা চুরির অভিশাপ নেমে আসে তাভারনিরের জীবনে। অনেকের ধারণা রাশিয়ায় বন্য কুকুরের হামলায় মৃত্যু হয় তার।

হীরাটির সঙ্গে ফিতা জড়িয়ে চতুর্দশ লুই তার গলায়ে এটি পরতেন। তিনি এটি কেটে ১১২ ক্যারেট থেকে কমিয়ে ৬৭ দশমিক ৫ ক্যারেটে নামিয়ে আনেন । গ্যাংগ্রিনে আক্রান্ত হয়ে মারা যান লুই। নিকোলাস ফ্যুঁকো নামে একজন রাজকীয় কর্মকর্তা একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের জন্য হীরাটি ধার নিয়েছিলেন। পরে তাকে হীরা চুরির অভিযোগে গ্রেপ্তার করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। কারাগারেই তার মৃত্যু হয়।

হীরাটি পরর্তীতে সম্রাট ষোড়শ লুইয়ের হাতে আসে । ফরাসি বিপ্লবের সময় ষোড়শ লুই ও তার স্ত্রী রাণী ম্যারি অ্যান্তোনিতিকে গিলোটিনে রেখে শিরশ্ছেদ করা হয়। বিপ্লবীরা ওই সময় রাজ পরিবারের কাছ থেকে হোপ ডায়মন্ড ও অন্যান্য রত্ম ছিনিয়ে নেয় । পরবর্তীতে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত হোপ ডায়মন্ডের আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। ১৮০০ সালের দিকে হল্যান্ডের এক রত্ন ব্যবসায়ীর কাছে পাওয়া যায় হীরাটি। কয়েক বছরের মধ্যে ওই ব্যবসায়ী সর্বস্বান্ত হয়ে যান নিজ ছেলে হেন্ড্রিকের জন্য। হেন্ড্রিক বাবাকে হত্যা করে এবং হীরাটি চুরি করে তুলে দেয় ফরাসী ব্যবসায়ী বেউলুর কাছে। ১৮৩০ সালে হেন্ড্রিক আত্মহত্যা করে। পরবর্তীতে হীরাটি ব্রিটেনের রাজা চতুর্থ জর্জের হাতে আসে । মূত্র থলিতে পাথর, স্থূলতাসহ বিভিন্ন রোগে মৃত্যু হয় তার। বিভিন্ন হাত ঘুরে ১৮৯৪ সালে ডিউক অব নিউক্যাসল লর্ড ফ্রান্সিস হোপের হাতে আসে এটি। তিনি বিয়ে করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা মে ইয়োহিকে। কিন্তু পরবর্তীতে দুজনের দাম্পত্য জীবন টেকেনি। এক পর্যায়ে দেনার দায়ে জর্জরিত লর্ড ফ্রান্সিস হীরাটি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন। হীরার পরবর্তী মালিক ফ্রান্সের জ্যাক কোলেট আত্মহত্যা করেন। এর পরের মালিক রাশিয়ার জার পরিবারের রাজপুত্র ইভান ক্যানিতোভিৎস্কি ১৯০৮ সালে নিহত হন।

এরপর চার লাখ মার্কিন ডলার দিয়ে তুর্কি সুলতান আব্দুল হামিদ হোপ ডায়মন্ড কিনে নেন। উপপত্নীদের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় সুবায়াকে তিনি এটি উপহার হিসেবে দেন। কিন্তু এর এক বছরের মাথায় তিনি সুবায়াকে হত্যা করেন । কিছুদিন পরে তিনি সিংহাসন থেকে সরে দাড়ান।
বিভিন্ন হাত ঘুরে এবার আমেরিকায় পাড়ি জমায় হোপ ডায়মন্ড। বিখ্যাত কার্টিয়ার জুয়েলার্সের মালিক পিয়েরে কার্টিয়ার এটি কিনে নেন। তিনি এটি বিক্রি করেন মার্কিন ধনুকবেরের মেয়ে ইভালিন ওয়ালশ ম্যাক্লিনের কাছে। পরবর্তীতে ম্যাক্লিনের জীবনে দুঃসহ যন্ত্রনা নেমে আসে। এক বছরের মাথায় তার আট বছরের ছেলেটি গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যায় এবং ২৫ বছরের মেয়ে আত্মহত্যা করে। এক পর্যায়ে ম্যাক্লিন নিজেই মরফিনে আসক্ত হয়ে পড়েন। স্বামী নেড ম্যাক্লিনকে উন্মাদ ঘোষণা করে আদালত। বৃদ্ধাশ্রমে মৃত্যু হয় নেডের।

শেষ পর্যন্ত নেডের উত্তরাধিকারীরা হীরাটি হ্যারি উইনিস্টন নামে এক ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে দেয়। হ্যারি এটি স্মিথসোনিয়ান ইন্সটিটিউশন নামে একটি জাদুঘরকে দান করেন। তখন থেকে হোপ ডায়মন্ড সেখানেই রয়েছে। অভিশাপ কিন্তু এরপরও পিছু ছাড়েনি। যিনি হীরাটি জাদুঘর কর্তৃপক্ষের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন, পরবর্তীতে সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি পা হারান। শুধু তাই নয়, পৃথক দুর্ঘটনায় তিনি মাথায়ও আঘাত পেয়েছিলেন।

একটি হীরা ঘিরে এতো অশুভ ঘটনা কেন ঘটলো তার ব্যাখ্যা আজও পাওয়া যায়নি। অনেকে অবশ্য একে কাকতালীয় বলে উড়িয়ে দিয়েছেন।
১৯৬৫ সালে এক গবেষণায় দেখা গেছে নীল রঙের হীরাটির ওপর বেগুনি রশ্মির প্রতিফলন ঘটালে এটি লাল বর্ণ ধারণ করে, যা অন্য কোনো হীরার বেলায় দেখা যায়নি।

তবে অনেকে একে বলে দুর্বাশার হীরা। অবশ্য সন্দেহবাদীরা বলেন, খামাখাই এই হীরার অলৌকিত্ব ও রহস্য বাড়ানোর জন্য এসব কাহিনী ফাঁদা হয়েছে।