উপলব্ধি

4429
0

ইফতারির টেবিলে বসেই খেয়াল করলাম আমার শাশুড়ি মা কেমন মন মরা হয়ে আছেন। ইফতারি তেও তেমন মনোযোগ নাই।

আমি জুসের গ্লাস টা ওনার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম, “মা, কোন সমস্যা!! কোন কিছু নিয়ে চিন্তিত আপনি?”
উনি বললেন, “না।” সাদাত কে আরও কয়টা বেগুনি দাও।” প্রসংগ টা আড়াল করার চেষ্টা।
সাদাত প্লেটের উপর হাত উচিয়ে না না করে উঠলো।

রাতে মেইন গেট বন্ধ করে শাশুড়ি মায়ের ঘরে একবার উকি দিয়ে দেখা আমার কর্তব্য। এই সাড়ে তিন বছরে প্রায় অভ্যাসও হয়ে গেছে।
একা মানুষ। তারপর বয়সও হয়েছে।

পর্দার এপাশে দাঁড়িয়ে মনে হল উনি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। থমকে দাঁড়ালাম
ভালো করে কান পেতে বুঝলাম আসলেই তিনি কাঁদছেন। কি করব বুঝতে পারছিলামনা।
মনে হল রুমে ঢুকে জিজ্ঞাসা করি। তখনই মনে হল তখন উনি ব্যাপার টা এড়িয়ে গেছেন।
আবার একটা মানুষ কাঁদছেন।
তাকে সেভাবে রেখে ঘুমাতে যাব, এটাও কেমন হয়!!

রুমে এসে আমার স্বামী সাদাত কে ডেকে তুললাম।
ও বিরক্তই হল বটে।
সবটা শুনে বেড থেকে নেমে চটি টা পায়ে গলিয়ে বেরিয়ে পড়ল।
আমি বের হতে যাব, আমার এগারো মাসের বাচ্চা মেয়েটা কেঁদে উঠলো।
ওকে দোলনা থেকে উঠিয়ে, ডায়াপার চেঞ্জ করে কোলে নিয়ে মায়ের রুমে গেলাম।

দেখি সাদাত মায়ের মাথার কাছে বসে মায়ের মাথায় হাত বোলাচ্ছে।
উনি এখনো কাঁদছেন।

শাশুড়ি মায়ের কথার সারমর্ম এই যে আজ দুপুরে আমার একমাত্র ননদ ফোন করেছিলেন।
দুপুরে বলেছিলেন এবার ইদে তাদের মায়ের কাছে না আসার সম্ভাবনা রয়েছে। ইদের আগেই বিদেশে যাচ্ছে ছুটি কাটাতে। এইজন্য মা চিন্তিত ছিলেন।

আর একটু আগে ফোন করে সাফ জানিয়ে দিল তারা আসতে পারবে নাহ।

আমার ননদের বিয়ের পর এই প্রথম তারা এই বাড়িতে ইদ করতে আসতে পারছে নাহ।
বছরে এমন একটা দুইটা বড় ছুটিটে তারা এ বাড়িতে আসে। মা ও নাতী নাতনী দের পেয়ে খুশি হন।
ওনার খারাপ লাগাই তো স্বাভাবিক।

আমি আর সাদাত যতদূর সম্ভব মাকে স্বান্তনা দিয়ে রুমে আসলাম।

ভোরবেলায় সেহেরি খেয়ে নামাজ শেষ করে রুমে ঢুকছি, মা দেখি ডাইনিং এ বসে আছেন।
আমি ভাবছি কাছে গিয়ে কিছু বলব কিনা তার আগেই উনি আমাকে ডাকলেন।
-সুমু, এদিকে আসো তো।
-দাঁড়িয়ে থেকো নাহ। বস এইখানে।
আমি বসলাম। উনি আমার ডান হাতটা ওনার হাতের মধ্যে নিলেন। আমি অবাকই হলাম।
কিছুক্ষণ বসে থাকার পর বললেন, “ইদের আর কতদিন বাকি?
-দুইদিন মা।
-আজকেই আমার প্রয়োজনীয় জিনিষ পত্র, আর শাড়ি, এসব দিয়ে একটা ব্যাগ গুছিয়ে রাখবা। সেই সাথে তোমার আর আমার নাতনীর ও একটা ব্যাগ রেডি করবা। ”
একটু দম নিলেন। বুঝলাম এখনো কথা বাকি আছে। তাই কিছু জিজ্ঞাসা করলাম নাহ।
উনিই আবার শুরু করলেন “সাদাত যদি কাল যেতে চায় তো ভালো আর না গেলে ইদের দিন যাবে। আমাদের কে গাড়ি করে পাঠিয়ে দিতে বলবা কালকেই। নাহয় আমিই বলব।”
-আমরা কি কোথাও যাচ্ছি মা??
-হ্যা, তোমার বাবার বাড়ি। এবার ইদটা আমরা ওখানেই করব।
টের পাচ্ছি মায়ের হাতের ভিতর আমার হাতটা কাপা শুরু করছে।
-দেখো সুমু, এই একটাবার আমার মেয়ে আমার কাছে ইদ করতে আসছে নাহ তাই আমি কাল সারারাত ঘুমাই নাই।
আর বিয়ের পর থেকে একটা বারও তুমি তোমার মায়ের কাছে ইদ করতে পারো নাই। এই প্রথম বার আমি বুঝলাম তোমার মায়েরও কতটা কষ্ট হয়।

চোখ দিয়ে জল পড়ছে। হাত দিয়ে মোছার কোন ইচ্ছাই নাই আমার।
শাশুড়ি মাও কাঁদছেন, “আমার মেয়েটা নিজে ঘোরার জন্য আমার কষ্ট টা দেখল নাহ। আর তুমি আমাদের জন্যই মায়ের কাছে যেতে পারোনা। এবার থেকে যতদিন মা বাবা বেচে থাকবেন তুমি ও বাড়িতেই ইদ করবা।
আমি বলছি।
আর যেবার এই বাসায় কেউ আসবে না সেবার আমাকেও নিয়ে যাবা।
তোমার মাকে বলে দাও কালই আমরা যাব।

নিঃশব্দে কাদার আর ক্ষমতা ছিল নাহ। মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিলাম।
প্রতিবার যে কান্না চাপা রেখে মাকে ফোন করে বলতাম, “মা, এবার ইদে আসতে পারব নাহ। আমার ননদ রা আসবে তো। বুঝই তো।” সেই সব চাপা কান্না আজ সশব্দে ঝরতে লাগলো।
শাশুড়ি মা আমাকে থামালেন নাহ। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলেন।

এই প্রথম ঠিক আমার মায়ের গায়ের গন্ধ পেলাম।
ঠিক আমার মায়ের মত।
অবশ্য আগেও হয়ত ছিল।
এত কাছে তো আগে আসা হয় নি।
তাই পাই নি। লেখাঃ Pro MI