তখন আমি অনার্স ১ম বর্ষের ছাত্রী ছিলাম।
ভার্সিটি তে উঠার পর প্রথম দিনই একটা বড় রকমের ক্রাশ খাইলাম।শুধু বড় বললে ভুল হবে,সিরিয়াস ক্রাশ বললে ভালো হয়।
ক্রাশ খাওয়ার কাহিনী টা বলি।
ভার্সিটি গেইটে প্রবেশ করা মাত্রই একজন ভদ্রলোক কে চোখে পড়লো।উনি বাইরে যাচ্ছিলেন আর আমি ভেতরে ঢুকতে ছিলাম।
ভদ্রলোককে দেখার পরই আমার মনে হলো চারিদিকে শীতল বাতাস বইতেছে,ব্যাকগ্রাউন্ডে ‘I am in love’ গান বাজতেছে আর চারপাশ থেকে মিষ্টি একটা সুঘ্রাণ আসতেছে..
আসলে ঐদিন আবহাওয়া একটু খারাপ ছিলো তাই চারদিকে শীতল বাতাস বইছিলো,ব্যাকগ্রাউন্ডের গান টা আমার বান্ধবীর ফোনে বাজতেছিলো আর সুঘ্রাণ ভদ্রলোকের জামা থেকে আসতেছিলো
ঘ্রাণ টা শুঁকেই বুঝতে পারছিলাম ভদ্রলোক ব্র্যান্ডেড পার্ফিউম ইউজ করেন।
এই ভদ্রলোকই আমার ‘সিরিয়াস ক্রাশ’।
বান্ধবী হেনার আপুর কাছ থেকে জানতে পারলাম ইনি আমাদের ভার্সিটিরই টিচার।
শুনে তো আমি খুশীতে অনেক জোরে একটা লাফ দিলাম।
লাফটা এতো জোরে দিছিলাম যে পায়ে মোচড় খাইছিলাম লাফ দেওয়ার সাথে সাথে। ?
এবং পুরো এক সপ্তাহ বেড রেস্টে ছিলাম।
এক সাপ্তাহ পর ভার্সিটি তে গেলাম।আমার চোখজোড়া সেই ভদ্রলোককে খুঁজতেছিলো সেদিন।
কিন্তু দুর্ভাগ্য। ভদ্রলোকের মানে আমাদের টিচারের দেখা পাই নি সেদিন।
ভার্সিটিতে নতুন তাই অনেকেই অপরিচিত, কাওকে স্যারের কথা জিজ্ঞেস ও করতে পারছিলাম না,কেন জানি লজ্জা লাগতেছিলো,মনেমনে ভাবতেছিলাম যদি কাওকে স্যারের কথা জিজ্ঞেস করি ওরা বুঝে ফেলবে আমি স্যারের উপর ক্রাশ খাইছি।তাই জিজ্ঞেস করলাম না কাওকে কিছু।
‘চোরের মনে পুলিশ পুলিশ’ টাইপ কিছু আর কি।
তারপর আবারো ১৫ দিনের জন্য ভার্সিটিতে যাওয়া বন্ধ ছিলো।আমার মামাতো বোনের বিয়েতে গেছিলাম।অনেকদিন পর নানাবাড়ি গেছিলাম তাই এতদিন থাকলাম নানাবাড়িতে।
ক্রাশ স্যারের কথা মনেই ছিলো না আমার, ভার্সিটিতে আসার পর মনে পড়লো যখন বান্ধবী হেনা এসে বললো স্যার ওদের ম্যাথ টিচার।
আমার ম্যাথ সাবজেক্ট ছিলো না তাই স্যারের ক্লাস করার সৌভাগ্য হলো না।
নিজের উপর রাগ হতে লাগলো কেন যে ম্যাথ নিয়ে পড়লাম না,ম্যাথে উইক না হলে তো আজ ক্রাশ স্যারের ক্লাস করতে পারতাম।
বলে রাখা ভালো আমি আর হেনা একসাথে হলে আমাদের মাথায় শুধু ‘শয়তানি বুদ্ধি’ খেলা করে।
রোজকার মতো সেদিনও দুই শয়তান একসাথে ছিলাম।হেনা বুদ্ধি দিলো মাঝেমধ্যে ওর ক্লাসে এসে ক্লাস করতে।প্রথম প্রথম ভয় পেয়েছিলাম তারপর একদিন সাহস করে ক্লাসে ঢুকে পড়লাম।ভয় তবুও একটু ছিলো মনে,তাই একেবারে পিছনের সাড়ির বেঞ্চে গিয়ে বসলাম।
ঐ দিনের কথা আমার এখনো মনে আছে।
আমি অতি মনোযোগ সহকারে ক্রাশ স্যারের ক্লাস করছিলাম,আসলে ক্লাস করছিলাম বললে ভুল হবে,আমি স্যারকে দেখতেছিলাম।
হঠাৎ খেয়াল করলাম স্যার আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।আজও সেদিনের মতো আমার হার্টবিটের গতি বেড়ে গেলো।আমি শীতল বাতাস অনুভব করলাম,ব্যাকগ্রাউন্ডে ‘main hoon hero tera’ গান বাজতেছিলো,স্যার ধীরেধীরে আমার দিকে এগিয়ে আসছিলেন এবং আমি সেদিনের মতো আজও সেই মিষ্টি ঘ্রাণ টা পাচ্ছিলাম।
স্যার আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন,এতক্ষণ ধরে কি পড়াইতেছিলেন জানতে চাইলেন।আমি হা করে স্যারের দিকে তাকিয়ে রইলাম এবং স্যারের ধমক শুনে আমার কান্না চলে আসলো।স্যার অপ্রস্তুত বোধ করছিলেন হয়তো কান্না করছি দেখে,আমি কিছু না বলেই ক্লাস থেকে বের হয়ে আসলাম।
ও হ্যাঁ বলে রাখি ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকটা পাশের একটা দোকানের মিউজিক বক্স থেকে আসছিলো আর শীতল বাতাস টা আসছিলো সিলিং ফ্যান থেকে।
বাস্তব জীবনে হিন্দি সিরিয়ালের মতো কিছুই ঘটে না।
আমি রাগে দুঃখে ভার্সিটিতে যাওয়া বন্ধ করে দিলাম।প্রায় দু সপ্তাহ হবে আমি যাইনি ভার্সিটিতে।
তারপর একদিন হেনা এসে বললো স্যার নাকি আমার সাথে দেখা করতে চান।
ওকে জিজ্ঞেস করলাম স্যার তো আমাকে চিনেনই না,আমার সাথে দেখা করতে চান কেন?
ও বললো স্যার নাকি আমাকে হেনার সাথে সেদিন আলাপ করতে দেখেছিলেন তাই হেনাকে আমার ব্যাপারে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করলেন।
পরদিন ভার্সিটিতে গেলাম।
মনেমনে অপেক্ষা করছি কখন ক্রাশ স্যারের ডাক আসবে।
এবং আমার অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো।ক্লাস শেষে ক্রাশ স্যার আমাকে ডেকে নিলেন।সেদিনের ব্যবহারের জন্য স্যার অনুতপ্ত। যদিও স্যার একবারও ‘স্যরি’ শব্দটি ব্যবহার করেন নি তবুও স্যারের কথা শুনে মনে হচ্ছিলো স্যার লজ্জিত সেদিনের ঘটনার জন্য।
আমিও স্যারকে আমার বাচ্চামোর জন্য স্যরি বলে নিলাম।
সেদিনের পর থেকে ক্রাশ স্যার আমাকে দেখলেই ডেকে নিতেন পাশে।হেনা ব্যাপারটা পছন্দ করতো না।ও তো স্যারকে প্রায়ই ‘লুচ্চা’ বলে গালি দিতো।
কিন্তু আমার কাছে ব্যাপারটা ভালো লাগতো।
যেহেতু স্যার আমার ক্রাশ সেহেতু উনার সাথে কথা বলতে আমার ভালোই লাগবে।এটাই স্বাভাবিক।
ধীরেধীরে স্যারের প্রতি ভালোলাগা টা বাড়তে লাগলো।
দেখতে দেখতে প্রায় দেড় বছর কেটে গেলো।
.
.
একদিন ভাবলাম স্যার হয়তো টিচার হওয়ার কারণে আমাকে প্রপোজ করতে লজ্জাবোধ করছেন তাই আমার উচিৎ স্যারকে প্রপোজাল পাঠানো।
যেই ভাবা সেই কাজ!
আমি স্যারকে প্রপোজ করার ব্যবস্থা করে নিলাম।একদিন বিকেলবেলা আমি বাইরে বের হইছিলাম।আমার ভাগ্য ভালো ছিলো,স্যারকে একটা ক্যাফেটেরিয়ায় বসে থাকতে দেখলাম।সেদিনের স্পেশালিটি হলো সেদিন তারিখ টা ছিলো ১৪ ফেব্রুয়ারি।
ভাবলাম এটাই উপযুক্ত সময় ক্রাশ স্যারকে প্রপোজ করার।
কিন্তু স্যারের সামনে গিয়ে প্রপোজ করতে ভয় পাচ্ছিলাম। তাই একটা পিচ্ছি ছেলের হাতে গোলাপ ফুল আর একটা চিরকুট (যেখানে লেখা ছিলো, আমি আপনাকে ভালোবাসি) দিয়ে স্যারকে দেখিয়ে বললাম এটা গিয়ে উনার হাতে দিয়ে আসো।
কিন্তু ছেলেটা ওগুলো স্যারের পাশের টেবিলে বসা এক বৃদ্ধার হাতে ওগুলো নিয়ে দিলো।
বৃদ্ধা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন,আমিও একটা হাসি দিয়ে ওখান থেকে চলে আসলাম।
এক মাস পর আবার ক্রাশ স্যারকে প্রপোজ করার চেষ্টা করলাম।
এবার আর পিচ্চি ছেলেকে পাঠালাম না।পাঠালাম আমার আরেক বন্ধু রিমন কে।কিন্তু গাধাটা স্যারের পাশে গিয়ে আবার ভয় পেয়ে চলে আসছে,কারণ ঐ দিন স্যারের মেজাজটা গরম ছিলো।
আরো কিছুদিন পর স্যারকে প্রপোজাল পাঠানোর চেষ্টা করলাম।
স্যার একদিন ক্লাসে বলছিলেন উনার নাকি ‘টেডিবিয়ার’ খুব পছন্দ,তাই আমি একটা টেডিবিয়ার কিনে নিলাম স্যারের জন্য।
ঐ দিন ছিলো মেঘলা দিন।স্যার ভার্সিটির ক্লাস শেষে একটা পার্কে গিয়ে বসলেন।আমিও স্যারকে ফলো করে গেলাম।
একটা বাচ্চার হাতে টেডিবিয়ার টা দিয়ে বললাম এটা এক দৌড়ে গিয়ে ঐ ভদ্রলোক কে দিয়ে আসো।সাথে ছিলো একটা চিরকুট।
ছেলেটা আমার কথামতো এক দৌড় দিলো,কিন্তু রাস্তা পিচ্ছিল থাকার কারণে ও হোচট খেয়ে পড়ে যায়,সাথে আমার টেডিবিয়ার টাও।
ও আমার পাশে এসে বলে আপু এটা এখন কি করবো?টেডিবিয়ার টা কাদায় মাখামাখি হয়ে গিয়েছিলো।
বললাম।ওটা তুমি তোমার বাসায় নিয়ে যাও,আম্মু কে বলো ধুয়ে দিবে।
মন খারাপ করে ওখান থেকে চলে আসলাম।
সেদিনও প্রপোজ করা হলো না ক্রাশ স্যারকে।
তারপর একদিন স্যার নিজ থেকে এসেই আমার সাথে কথা বললেন।অনেক সময় আমরা একসাথে আলাপ করলাম।তারপর স্যার চলে যাওয়ার সময় আমাকে স্যারের বাসায় যাওয়ার জন্য ইনভাইট করলেন।
আমি স্যারের বাসায় দাঁড়িয়ে আছি।আমার একহাতে একটা ছোট ফুলেরতোড়া আর আরেক হাতে একটা বড় টেডিবিয়ার। ওটা কোলে তুলে দাঁড়িয়ে আছি ওখানে।চারপাশের মানুষ হা করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।স্যার আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন।আর আমি হা করে তাকিয়ে রইলাম স্যারের দিকে।
স্যারের বাসায় পার্টি হচ্ছে।স্যারের মেয়ের বার্থডে পার্টি।১ বছর পূর্ণ হয়েছে ওর।ফুলেরতোড়া টা স্যারের বউ কে আর টেডিবিয়ার টা মেয়ের জন্য রেখে বাসায় চলে আসলাম।
স্যার ম্যারিড ছিলেন এটাই জানতাম না,বাসায় গিয়ে স্যারের মেয়ের বার্থডে কেকও খেয়ে আসলাম!
This is called reality!
(দীর্ঘনিঃশ্বাস এর ইমো হবে)