অপরাজিতা

4357
0

ওকে শেষবার দেখেছিলাম পঞ্চম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের দিন। নীল সাদা স্কুলড্রেস, হাসিমুখ, টোলপড়া গাল আর রেজাল্টের টেনশনে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে জমাট বদ্ধ মনোবলের মেয়েটা। আমি সেদিন দ্বিতীয় হয়েছিলাম। ইনফ্যাক্ট ক্লাস ওয়ান থেকে ফাইভ পর্যন্ত কখনোই প্রথম হতে পারিনি। এমনকি কোন কো-কারিকুলাম এক্টিভিটিসেও না। কারণটা সেই -টোলপড়া গাল আর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা মেয়েটা। বরাবরের প্রথম হওয়া মেয়েটার নাম ছিলো অপরাজিতা!

যেমন নাম, তেমন কর্ম। আর যেমন কর্ম করতো সে ঠিক তেমনই ফল পেতো। আমার অবশ্য খুব রাগ হতো বারবার ওর কাছে দ্বিতীয় হতে। আমি তাই রেজাল্ট পেয়েই ফুলে ওঠা বেলুনের মতো গাল ফুলিয়ে বসে থাকতাম। আর অপরাজিতা টোলপড়া গালের স্নিগ্ধ হাসি নিয়ে ছুটে আসতো আমার কাছে। বলতো চল, গোল্লাছুট খেলি, রেজাল্ট গোল্লায় যাক। আমার রাগ লাগতো, ভীষণ রাগ! অদ্ভুত বিষয় এই যে প্রথম হয়ে আলাদা উচ্ছ্বাস কখনোই কাজ করতো না অপরাজিতার মধ্যে যেটা অনেকটা আমার রাগের আগুনে ঘি ঢালতো। তারপর বরাবরের মতো অপরাজিতার কাছে পরাজিত হয়ে ছুটে যেতাম গোল্লাছুটে ছুট দিতে- রেজাল্ট, সে গোল্লায় যাক-ক্ষতি কি!

অপরাজিতার এক ভাই ছিলো-নাম অজয়। দুবছরের ছোট আমাদের থেকে। আমরা ওকে ডাকতাম-অলাজ নামে। অলাজ মানে-অপরাজিতার লেজে থাকেন যিনি! নিজের ক্লাস বাদ দিয়ে সারাদিন বোনের পিছন পিছন ঘুরে বেড়ানো, বোনের ক্লাসে বসে থাকা, স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অপরাজিতার গাওয়া -“বিদ্যালয়, আমাদের বিদ্যালয় /এখানে সভ্যতারই ফুল ফোটানো হয়”-গানের পর বিকট শব্দে দীর্ঘকালীন হাততালি দেয়া পর্যন্ত সবেতেই ছিলো অজয়ের একচ্ছত্র বিচরণ। আমার ধারণা হাততালি দেয়ার কোন প্রতিযোগিতা হলে তাতে অপরাজিতা নয় বরং অজয় প্রথম হতো! তবে অজয় সবচেয়ে খুশি হতো যেদিন স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্ট দিতো সেদিন। যদিও অজয় নিজের ক্লাসে প্রথম হতো, তারপরও যখন বোন অপরাজিতার রেজাল্ট জানতো তখন তার আনন্দ আর ধরতো না। বছরে এই একটা দিনই সে তার বোনের লেজ ছেড়ে একছুটে চলে যেতো তার মায়ের কাছে। মাকে জড়িয়ে ধরে আকাশ-পাতাল এফোঁড়ওফোঁড় করে দেয়া চিৎকারে জানান দিতো – “মা, জানো দিদি প্রথম হয়েছে।”

তারপর আমি ও আমার পরিবার বাবার চাকরীর বদলি জনিত কারণে চলে আসি সেই স্কুল, গ্রাম আর অজয় অপরাজিতা থেকে। পুরোনো বন্ধুদের ছেড়ে যেতে কষ্ট হয়েছিলো বটে তবে মনে মনে আনন্দ পেয়েছিলাম এটা ভেবে যে আর আমাকে অপরাজিতার কাছে পরাজিত হতে হবে না। তারপর একে একে কেটে গেছে চৌদ্দটি বছর। পুরোনো বন্ধুদের স্মৃতি বলতে পঞ্চম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষার আগে তোলা একসাথে আমাদের গ্রুপ ছবি যাতে অনেকটা খণ্ড ৎ এর মতো অপরাজিতার সাথে লেপ্টে ছিলো অজয়। আশ্চর্যকথা এই যে সময়ের ঘূর্ণিপাকে আমি আজ এমন একটি এলাকার শিক্ষা কর্মকর্তা যে এলাকায় কেটে গেছে আমার শৈশবের প্রাথমিক পাঠ, যার সঙ্গী ছিলো আমার তৎকালীন পরাজয়ের একমাত্র কারণ অপরাজিতা।

গতকাল আমার সেই পুরোনো স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে আমাকে প্রধান অথিতি করে নেয়া হয়েছিলো। পঞ্চম শ্রেণির ফলাফল প্রকাশ করতে গিয়ে সহকারী প্রধাণ শিক্ষক ঘোষণা করলেন এবারো পঞ্চম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছে- অপরাজিতা! আমি ফিরে গেলাম সেইদিনগুলোতে। হঠাৎ করে লক্ষ করলাম আমাদের বয়সী একজন শিক্ষক হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে যাচ্ছেন অনুষ্ঠানস্থল থেকে। কারণ জানতে চাইলে প্রধান শিক্ষক আমাকে বললেন- আজ থেকে চৌদ্দ বছর আগে আমাদের স্কুলে একটি মেয়ে পড়তো -নাম অপরাজিতা। প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত একাডেমিক বা নন একাডেমিক কোন পরীক্ষা বা প্রতিযোগিতায় কোনদিন দ্বিতীয় হয়নি সে। বরাবরের অপরাজিত প্রথম অপরাজিতা! ষষ্ঠ শ্রেণিতে মেয়েটি ঘন ঘন জ্বরে পড়তে শুরু করে। কিছুদিন পর জানা যায় মেয়েটি ক্লোনক্যান্সারে আক্রান্ত। তার তিনমাস পর মৃত্যুর কাছে প্রথম বারের মতো পরাজিত হয় আমাদের প্রথম হওয়া কণ্যা -অপরাজিতা! আর এই মূহুর্তে যে লোকটি হাউ মাউ করতে করতে ছুটে গেলো, সে আমাদের স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র এবং বর্তমানের শিক্ষক, নাম অজয়। বড্ড বেশি ভালোবাসতো দিদিকে। তার ধারণা তার দিদি এখনো আগের মতোই প্রথম হয়। আর সেও খবরটা নিয়ে ছুটে যায় তার মায়ের কাছে। আর সেই থেকে আমাদের স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে বরাবরই প্রথম হয় অপরাজিতা!
.
.
.
প্রধানশিক্ষক স্যারের কথা শেষ হতেই আমি পিছু নিলাম অজয়ের। অজয়ের বাড়ি পৌছে দেখি, বরাবরের মতো অজয় তার মাকে জড়িয়ে ধরে আকাশ-পাতাল এফোঁড়ওফোঁড় করে দেওয়া চিৎকারে জানান দিচ্ছে –
জানো মা, আমার দিদি আবারো প্রথম হয়েছে…। লেখাঃ শুভেন্দু সাহা..