মো: রাসেল আহম্মেদ, লিসবন, পর্তুগাল
পাহাড় গুহা এবং সমুদ্র সৈকত সম্বলিত পর্তুগালের এক মায়াবী দ্বীপের নাম বেরলিঙ্গা। আমরা প্রবাসী বাংলাদেশিরা লিসবনে প্রতি বছর বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক ও আঞ্চলিক সংগঠনের ব্যানারে এক সঙ্গে দেড়শো থেকে দুইশত জন মানুষ নিয়ে নানান পর্যটন স্পটে ভ্রমণের আয়োজন করি। শিক্ষামূলক এই সফর হয়ে উঠে বাংলাদেশি প্রবাসীদের এক মিলনমেলায়। স্বতঃস্ফূর্তভাবে সবাই অংশগ্রহণ করে এবং যথাযথ নিয়মকানুন মেনে সবাই একটি সুন্দর ভ্রমণ সম্পন্ন করে। যার শুরু থেকে শেষ অবধি থাকে শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা যা সাধারণত আমাদের দেশের এমন কোন আয়োজনে প্রতিপলন ঘটানো খুবই কঠিন।
আটলান্টিকের পাড়ের দেশ হওয়াতে পর্তুগালের রয়েছে ছোট বড় অসংখ্য দ্বীপ ভূমি। কয়েকটি দ্বীপ ছাড়া বেশির ভাগেরই স্থায়ী কোন বাসিন্দা নেই কিন্তু বছরের একটি নিদিষ্ট সময়ে সেখানে সারা বিশ্ব থেকে পর্যটকের বেশ আনাগোণা দেখা যায়। বেরলিঙ্গা হচ্ছে এমনই একটি দ্বীপ। দ্বীপটির প্রধান বৈশিষ্ট হলো মনোমুগ্ধকর পাহাড়ি ভূমি, রয়েছে ছোট বড় অসংখ্য গুহা ও ছোট আকারের সমুদ্র সৈকত। বেরলিঙ্গা দ্বীপপুঞ্জ অনেকগুলো ছোট ছোট দ্বীপ নিয়ে গঠিত হয়েছে। যারা সাগর, পাহাড়, সৈকত ও রোমাঞ্চকর ভ্রমণ পছন্দ করেন তাদের জন্য চমৎকার এই দ্বীপ। আটলান্টিকের উত্তাল ঢেউ ডিঙ্গিয়ে অজানা গুহা সম্বলিত কোন নির্জন স্থানে যাওয়ার অনুভূতি অন্যরকম।
লিসবন শহর থেকে প্রায় ১০৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সাজানো গোছানো দ্বীপ আকৃতির ছোট শহর যার নাম হচ্ছে পেনিস। এই শহরটি মাছ ধরার জন্য বিখ্যাত। আমরা লিসবন থেকে রওনা দিয়ে হোটেলে সকালে নাস্তার বিশ মিনিট বিরতিসহ ১ ঘন্টা ৩০ মিনিটে পৌছে গেলাম পেনিস শহরে। সেখানে আগে থেকে ভাড়া করা জাহাজ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। সকলে সারিবদ্ধভাবে ও সুশৃঙ্খল হয়ে একে একে জাহাজের আসন নিতে লাগলাম। ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত একজনও কোন জাহাজে উঠতে পারে না এবং সকল যাত্রীর জন্য লাইফ জ্যাকেটের সিটের নিচে রক্ষিত আছে। তাছাড়া দুর্যোগকালীন বিপদের সমস্ত ব্যবস্থা করা আছে। এখান থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার পশ্চিমে আটলান্টিক মহাসাগরে মধ্যে অবস্থিত বেরলিঙ্গা নামের দ্বীপপুঞ্জটি। জাহাজের মাধ্যমে ৪৫ মিনিটের পথ। আটলান্টিকের গাড় নীল রঙ্গের পানি ও বিশাল আকৃতির ঢেউ ডিঙিয়ে আমরা সামনের দিকে ছুটে চলছি। আগত সবাই মহাসাগরের সৌন্দর্য্য উপভোগে ব্যস্ত সময় পার করছে। দ্বীপটির আয়তন প্রায় ৪৫ একর। দ্বীপটি খুবই অসাধারণ এবং নির্জন প্রকৃতির এক মায়াবী স্বপ্নপূরী। এখানকার স্বচ্ছ পানি যে কাউকে বিমোহিত করবে। দ্বীপের চারপাশে খাড়া পাহাড় থেকে চারিদিকে শুধু নীল রঙের পানিই দেখা যায়। সেই সাথে দেখা যায় ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে বেড়ানো নানান রঙের পাখি।
এখানে Sao Joao Baptista নামে একটি দুর্গ রয়েছে যেটি তৈরি হয়েছিল 17th Century তে। সংকীর্ণ একটি রাস্তা দিয়ে এই দুর্গে প্রবেশ করতে হয়। প্রাগৈতিহাসিক এই দুর্গ স্থাপত্যশৈলীর এক অনন্য নিদর্শন। কথিত আছে এই দূর্গ সেনাবাহিনী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল, জলদস্যুর আক্রমণ থেকে শহরকে রক্ষা করার জন্য। ভগ্নপ্রায় এই দুর্গ এখন পর্যটকদের জন্য রাত্রিযাপনে ভাড়া দেওয়া হয়। ভাড়া প্রতি রাতে ৩০ থেকে ৫০ ইউরো।
এই দ্বীপে কিছু ছোট ছোট ঘর রয়েছে জেলেদের বসবাসের জন্য। এছাড়া ছোট আকারের সমুদ্র সৈকত এবং একটি ক্যাফে ও রেঁস্তোরা রয়েছে। ছোট ছোট বোট ভাড়া করে পুরো দ্বীপের চারপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করা যায়। দুপুরের খাবারের পরে আমরাও ৮/১০ জন করে ছোট ছোট বোট নিয়ে দ্বীপের চারপাশের সৌন্দর্য্য দেখতে বোটে উঠে পড়লাম। বোটে একজন গাইড আমাদের দ্বীপের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে অবহিত করলেন এবং ভয়ংকর সব সংকীর্ণ গুহা দিয়ে আমাদের বোট চালনা করলেন। ভয়ংকর সুন্দর এক প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করলাম সবাই ২৫ মিনিটের সেই বোট ভ্রমণে।
হাজার হাজার পর্যটকের সমাগম থাকলেও দ্বীপের পরিবেশ খুবই পরিষ্কার এবং সাজানো গোছানো। যেহেতু এটি পর্তুগালের একটি সংরক্ষিত দ্বীপ তাই একটু পর পর বিভিন্ন সর্তকতামূলক সাইনবোর্ড সাঁটানো আছে এবং সকল পর্যটক সেসব অনুসরণ করছে। দ্বীপটি বাংলাদেশের সেন্টমার্টিন বা মহেশখালী দ্বীপ এর থেকে আরো অনেক বেশী সুন্দর এবং প্রাকৃতিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ। শুধুমাত্র সঠিক ব্যবস্থাপনা, প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা ও যাতায়াতের দুরাবস্থার কারণে কাংখিত পর্যটক আকর্ষণ করতে পারছে না। আর এখানে সাধারণ একটি স্থানকে নিয়ম-কানুন ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার ফলে অসাধারণ পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত করেছে। আরো পরিতাপের বিষয় হলো একই মানুষগুলো দেশে এক রকম আচরণ এবং বিদেশে সম্পূর্ণ বিপরীত আচরণ করে! পুরো ভ্রমণের কোথাও মনে হয়নি আমরা এতগুলো বাংলাদেশি একত্রে ঘুরতে বেড়িয়েছিলাম কারণ সবাই ছিল খুবই সচেতন ও দায়িত্বশীল। তাই ভ্রমণটি আরো মনোমুগ্ধকর হয়ে উঠেছিল।
প্রবাসে আপনার অভিজ্ঞতা, কমিউনিটির খবর, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, ব্যাবসা, কমিউনিটি বিষয়ক চিন্তা-চেতনা, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংঘঠন, স্মৃতিচারণসহ যে কোনো বিষয়ে লিখে পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা – amaderparis@gmail.com