মোহাম্মাদ নাজমুল কবির, প্যারিস: প্রবাসজীবনে সবচেয়ে কষ্টভারাক্রান্ত অংশ হলো একাকিত্ব, স্বজন আর বান্ধববিচ্ছিন্নতা। জীবনের নিকেশ মেলাতে জীবন থেকেই হারিয়ে যায় অনেক কিছু। জীবন এখানে কেবল ‘রেমিট্যান্স মেশিন’, মাইনুদ্দীন ভাইয়ের ভাষায়। জীবনধারনের সফট্ওয়ারের ভেতর যে প্রোগ্রামিং ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে ইউরো, ডলার পাউন্ড কিংবা পেট্রো-ডলার পকেটস্থ করতে, সেই গন্ডি থেকে বেরিয়ে মুক্ত বাতাসে বুক ভরে একটি নিশ্বাস নেবার বাতায়নটি কোথায়?
হ্যা, এমন একটি বাতায়ন বিনির্মানে কাজ করে চলেছে বাংলাদেশ কমিউনিটি ইন ফ্রান্স – বি সি এফ। কেবল রেমিট্যান্সের বেদীতে পূজার্ঘ্য দেয়াই এই প্রবাসে পরিযায়ী মানুষগুলোর কাজ হতে পারে না। কিছুতেই না। এই উপলব্ধি নিশ্চিতভাবেই বি সি এফ এর, অথবা এটি হবার কথাতো কমিউনিটিতে বিদ্যমান সকল সামাজিক এমন কি রাজনৈতিক সংগঠনগুলোরও। কিন্তু সেই তাড়না বা আকুতির প্রয়োগমূখী প্রতিফলন কোথায়?
প্রবাসী বাংলাদেশী পরিবার এবং ব্যক্তিরা এখানে বিচ্ছিন্ন এবং অন্তর্মূখী জীবন যাপন করে। ফরাসী সমাজে তাদের বিচরন এখনও নক্ষত্রের দূরত্বে, নির্দ্বিধায় বলা যায়। কেননা ফরাসী ভাষা আমাদের মুখে এখনও রোচে না, বদ হজম হয় হামেশাই। চর্চা বা চেষ্টার মনটি ভাষা-ভীতির কাছে বন্ধক দেয়া। এদেশীয় সংস্কৃতি আর আমাদের ধর্মীয় আচার একসাথে যায় না। যেন একটি অনতিক্রম্য দেয়াল এটি। অচলায়তন ভাঙার রসদ আমাদের হাতে নেই।
এই প্রেক্ষাপটে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, ধর্মীয় উৎসবের একটু গন্ধ কোথাও পেলে আমরা ছুটে যেতে চাই বাধনহারা গতিতে। বি সি এফ এমন তাগিদই অনুভব করে সর্বদা।
গতকাল শুক্রবার প্যারিসের একটি পার্কে আয়োজন করা হয় ঈদ পূনর্মিলনী অনুষ্ঠানের। কিন্তু এ আয়োজনটি সাধারনের চিন্তায় বাসার চার দেয়ালেই হবার কথা! বি সি এফ এই দেয়ালবন্দী উৎসবকে নিয়ে এসেছে মুক্ত আলোয়।
আয়োজনটি একেবারেই আচানক। পরিসরটিও কল্পনায় ক্ষুদ্র ছিলো, একেবারেই সাদামাটা। শংসয় ছিলো আয়োজকদের মাঝে, এমন একটি আহবানে কজনই বা আসবে প্রবাস জীবনের ঠাসবুনটের এই ব্যস্ততায়! কিন্তু অভ্যাগতদের অবিশ্বাস্য সংখ্যক উপস্থিতি আয়োজকদের বিস্মত করেছে, আপ্লুত করেছে।
বিশাল মাঠের ভেতর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শিশু, তরুন-তরুনী, দম্পতি, অভিভাবক, ব্যচেলর- কারা নেই এখানে! শিশুদের বাধভাঙা উচ্ছাস, কানামাছি ভো ভো ছুটে চলা। প্রবাসে সে এক অপরূপ দৃশ্য।
পূনর্মীলনী অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন রীমা আপা, মাইনউদ্দীন ভাই। ছিলো গান আর নাচ। রিভোলী স্টোর যথারীতি হাজির এক ঝুরি শুভেচ্ছা উপহার নিয়ে। উপস্থিত শিশুদের হাতে তুলে দেয়া হয় উপহারস্বরূপ। উপহার পেয়ে আত্মহারা শিশুরা মায়ের শিখিয়ে দেয়া ‘Merci’ বলারও ফুরসত পায়নি।সেকি বাধভাঙা উচ্ছাস!
ঈদ উপলক্ষে এমন একটি অায়োজন হবে আর কোন খাবারের আয়োজন থাকবে না তা কি হয়! এখানে বসবাসরত বেশ কিছু পরিবার সারাদিন নিজ হাতে পাক করে বাসায় না খেয়ে খাবার নিয়ে ছুটে এসেছে এখানে, এই পার্কে! সকলে যে অপেক্ষা করছে। ভোজনতো কেবল ভূরি পূর্ণ করবার ব্যাপারই নয়, এ এক আনন্দের ভাগাভাগি। মন পূর্ণতার আয়োজন।
বিপুল উপস্থিতি দেখে আয়োজক সংগঠন বি সি এফ ভাবছে আরো বড় কিছু নিয়ে। বলছিলেন বি সি এফ এর পরিচালক এম ডি নূর, আজকের এই বিপুল উপস্থিতি আমাদের অনুপ্রানিত করেছে, উৎসাহিত করেছে আগামীতে বড় পরিসরে এমন আয়োজন করবার। তা হবে আরো সংগঠিত, সুশৃঙ্খল এবং বর্নাঢ্য।
পারস্পরিক দেখাশোনা, আলাপচারিতা, খোশগল্প, হৈহুল্লোড়, দিক-বিদিক ছোটাছুটি, বাথরুমের গন্ডি বেরিয়ে সহজাত শিল্পীদের হেরে গলায় গান গাওয়া, না থাকুক তাতে সূর-তাল-লয়ের গ্রন্থিল গাথুনী। উচ্ছাসটাই এখানে মূখ্য, বৃত্ত-বন্দীত্বের ঘেরাটোপ টপকে বেরিয়ে আসাটাই আসল!
ভবিষ্যতের আয়োজনটি হবে বৃহত্তর, বর্নাঢ্য, আর জন উপস্থিতি বাড়বে ক্রমশ – বি সি এফ সেই চেষ্টায়ই থাকবে।